ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাকার্তায় আফ্রো-এশীয় শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী

সন্ত্রাস ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় চাই সম্মিলিত উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

সন্ত্রাস ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় চাই সম্মিলিত উদ্যোগ

বিডিনিউজ ॥ বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ২২০ কোটি মানুষের কথা তুলে ধরে সন্ত্রাস ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আফ্রো-এশীয় শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে এ আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাকার্তার বালাই সিদাং কনভেশন সেন্টারে এ সম্মেলনে ৩৪টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ ১০৫টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। বক্তব্যে ২০১৫ সাল পরবর্তী উন্নয়নসূচীতে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষুধা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রপন্থা দমন, এবং টেকসই উন্নয়ন-সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে করেন তিনি। এ সব লক্ষ্য পূরণে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে আফ্রো-এশীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। “শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ বিশ্ব গড়ে তুলতে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বে সম্মিলিত ও দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ গতিশীল সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি।” তিনি বলেন, “এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের পথ যারা প্রশস্ত করে দিয়ে গেছেন এ সম্মেলনের ৬০তম বার্ষিকীতে সেই বিচক্ষণ নেতাদের স্মরণ করছি আমি। তারাই বিশ্বকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের সুতোয় গেঁথে গেছেন। তারা লড়াই করে গেছেন উপনিবেশবাদ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে।” জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার বাবা সবসময়ই একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে কোন যুদ্ধ, সংঘাত ও ধ্বংস থাকবে না। তিনি বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের জন্য লড়েছিলেন। একইসঙ্গে মানবতার কল্যাণ ও শান্তির জন্য বিশ্বের সবগুলো রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছিলেন। এ প্রত্যয়ে থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বিশ্বে এখনও ২২০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এখনও ৮০ কোটি মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে এবং ২০ কোটির বেশি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করছে।” দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ধরিত্রী রক্ষায় ‘দক্ষিণ-দক্ষিণ’ সহযোগিতার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথাও তুলে ধরেন তিনি। ২০১৫ সাল উত্তর উন্নয়নসূচী নির্ধারণে আগামী মাসে ঢাকায় ‘সাউথ সাউথ অ্যান্ড ট্রাইঙ্গুলার কো-অপারেশন ইন দ্য কনটেক্সট অফ দ্য পোস্ট-২০১৫ ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের কথা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে, বলেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার বিষয়টি ‘কোন দেশের একার কাজ নয়’ মন্তব্য করে এক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে, বিশেষত দক্ষিণের দেশগুলোর সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “বিশ্বের মোট জিডিপির অর্ধেক আসে দক্ষিণের দেশগুলো থেকে। বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের অর্ধেক আসে এ সব দেশ থেকে এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক হয় এ অংশ থেকে। তাই টেকসই উন্নয়ন এবং দক্ষিণের দেশগুলোর বিপদ সামাল দেয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন জরুরী। উন্নয়নে গতি, শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন, সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থা দমন, মানবপাচার রোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বের দক্ষিণভাগের দেশগুলোর পারস্পারিক সহযোগিতা ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও মেয়াদ পূর্তির আগেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য, ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়গুলো তুলে ধরেন তিনি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি) আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা আমাদের ক্রমবর্ধমান তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে আরও বেশি বিনিয়োগ করছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী। অভিবাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রসঙ্গ টেনে এক্ষেত্রে সাউথ-সাউথ সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি। দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও নারী ক্ষমতায়ন এবং অপরাধীর ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’ বন্ধের জন্য তার সরকার কাজ করছে বলে জানান শেখ হাসিনা। আফ্রো-এশীয় সম্মেলনের প্রথম সমাবেশ ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়াতেই হয়েছিল ‘বান্দুং সম্মেলন’ নামে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ণর উদ্যোগে সেই সম্মেলনের প্রভাবে দুই বৃহৎ বিশ্ব জোটের বাইরে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম)। ৬০ বছর পূর্তিতে ইন্দোনেশিয়াই এবারের সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসেবে রয়েছে। ১৯ থেকে ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতিসংঘ, আসিয়ান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, আরব লীগ ও সাউথ সেন্টারসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৮টার দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হোটেল ‘বোরোবুদুর জাকার্তা’ থেকে মোটর শোভাযাত্রা সহকারে বালাই সিদাং জাকার্তা সম্মেলন কেন্দ্রে নিয়ে নিয়ে আসা হয়। সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদো শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান। এরপর বিভিন্ন দেশের নেতাদের ছবি তোলার পর্ব শেষে অন্যদের সঙ্গে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্য দেয়ার পর প্রথম পর্বে চীনসহ কয়েকটি দেশের নেতারা ভাষণ দেন। মধ্যাহ্নবিরতির পর দ্বিতীয় সেশন শুরুর পরপরই বক্তব্য দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলন শেষে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা ফেরার কথা রয়েছে শেখ হাসিনার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, সচিব মোঃ শহীদুল হকসহ উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও সাংবাদিকসহ ৫১ জন জাকার্তায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন। বাসস জানায়, উন্নয়ন ও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে দুই মহাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিকাশে একটি দৃঢ়ভিত্তি গড়ে তুলতে নতুন পন্থা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে আফ্রো-এশিয়ান নেতৃবৃন্দ বুধবার জাকার্তায় একত্রিত হয়েছেন। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় মহাদেশের অংশীদারিত্ব জোরদার, অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল নিয়ে আলোচনা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে ৩ দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো জাকার্তা কনভেনশন সেন্টারে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ৩৪ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন- চীন ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট এবং জাপান ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী। ৫৫ বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার বানদুং শহরে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় শীর্ষ সম্মেলনের ৬০তম বার্ষিকী স্মরণে এবং ২০০৫ সালে গঠিত নতুন এশিয়ান-আফ্রিকান স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের (এনএএএসপি) দশম বার্ষিকী উপলক্ষে এবারের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থায়ুযুদ্ধের চরম সময়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) গঠন করতে বানদুং কনফারেন্স হিসেবে পরিচিত ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়ান-আফ্রিকান কনফারেন্স এই মহাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এশিয়ান ও আফ্রিকার ১০৫ দেশের প্রতিনিধি, ১৫ পর্যবেক্ষণ দেশ ও ১৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। ৬০ বছর আগে শুরু হওয়া বানদুং চেতনার আলোকে জোটবদ্ধতার দৃঢ়করণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা এগিয়ে নেয়া এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির পন্থানুসরণের লক্ষ্যে দুই মহাদেশের প্রতিনিধিগণ এ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাদের অভিমত ব্যক্ত করবেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামের এখনও শেষ হয়নি। তিনি বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধি এগিয়ে নিতে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদারের ব্যাপারে এসব সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের ওপর নতুনভাবে আলোকপাতের আহ্বান জানান। তিনি দুই মহাদেশজুড়ে স্থিতিশীলতার প্রয়াস ও সমতার সমর্থনে একটি নতুন সমন্বিত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানান। জোকো উইদোদোর উদ্বোধনী ভাষণের আগে ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীরা এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে যোগ দেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে অংশ নেন- চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং, ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ট্রুং ট্যান স্যাং, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউ থেইন সেইন, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে, জর্দানের বাদশা আবদুল্লাহ ইবনে আল-হাসান, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশিল কৈরালা, ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী ড. রামি হামদুল্লাহ, জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি হেইসেন লুং এবং কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুনসেন।
×