ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ

ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া...

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২১ এপ্রিল ২০১৫

ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া...

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ ‘ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি, হেলিয়া দুলিয়া... এ গান গেয়ে গ্রাম বাংলার নারীরা এক সময় ঢেঁকিতে পাড় দিতেন। ভানতেন ধান, চালসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার সেই শব্দ এখন আর শোনা যায় না। কবে থেকে ঢেঁকির প্রচলন শুরু হয়েছিল সেটি সঠিক করে বলা সম্ভব না হলেও আশির দশক থেকে যে এর ব্যবহার কমতে শুরু করেছে বলে অনেকে মনে করেন। সেই চিরচেনা ঢেঁকি এখন অনেকের কাছে শুধুই স্মৃতি। এক সময় এ দেশের প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ঘরে ঘরে ছিল ঢেঁকি। ভোর হতে না হতেই বাংলার নারীরা ঢেঁকি দিয়ে ধান, চাল ও গম ভানতে শুরু করতেন। ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ত। এভাবেই দিনভর ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম। ঢেঁকি সাধারণত নারীরাই ব্যবহার করত। ঢেঁকি কমপক্ষে দু’জন নারীকে চালাতে হতো। সাধারণত ঢেঁকির দুটি অংশ। সামনের অংশে এক নারী ফাঁকে ফাঁকে হাত দিয়ে যা ভাঙ্গাত তা নেড়ে দিত। পেছনের অংশে দু’নারী অথবা এক নারীকে পায় দিয়ে ঢেঁকি নিচের দিকে আঘাত করত। এতেই ঢেঁকি ধাপুর-ধুপুর শব্দে ধান, চাল কিংবা গম ভানত। একটি ঢেঁকির সাধারণত ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। সাধারণত বাবলা, তেঁতুল, গাব কিংবা কড়ইসহ নানা জাতীয় শক্ত গাছ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা হত। শীতের দিনে গ্রাম-গঞ্জে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো। তাছাড়া বাড়িতে অতিথি আসলে কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু হলেই পিঠা তৈরির জন্য চাল ভানতে ঢেঁকির ব্যবহার করতে হতো। প্রাচীনকাল থেকে ধান, গম ও চাল ভানতে নারী ও গৃহবধূরা ঢেঁকির ওপরই নির্ভর করত। ঢেঁকি ছাড়া ধান, চাল, গম ভাঙ্গানো ভাবাই যেত না। এভাবেই আশি দশক পর্যন্ত ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছিল। এখন পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি হাট-বাজারে পৌঁছে গেছে বিদ্যুত। গ্রামে শ্যালো ইঞ্জিন কিংবা ধান ভাঙ্গার মেশিনও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাসমান মেশিন দিয়েও এখন ধান, চাল, গমসহ নানা জাতীয় খাদ্য সামগ্রী ভাঙ্গানো হচ্ছে। এখন ঢেঁকি দিয়ে কাউকে ধান কিংবা গম ভেঙ্গেছে তা শোনা যাচ্ছে না। আবার কোন কোন এলাকায় ঐহিত্য হিসেবে ঢেঁকি দিয়ে শুধু পিঠার তৈরির জন্য ধান ভানা হয়ে থাকে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে ঢেঁকি চিনতে পারবে কিনা তাও সন্দেহ রয়েছে। এক সময় গ্রাম বাংলার হাট-বাজারে ঢেঁকি কিনতে পাওয়া যেত। এখন আর হাট-বাজারে কেউ ঢেঁকি বিক্রয় করতে দেখছেন বলেও শোনা যাচ্ছে না। পদ্মা নদী ঘেঁষেই শরীয়তপুর জেলা। জেলার প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে এক সময়ে ঢেঁকির ব্যাপক প্রচলন ছিল। শুধু শরীয়তপুর জেলাই নয় সারাদেশেই ঢেঁকির কদর ছিল। শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ছাব্বিপপাড়া গ্রামের জলিল ঢালীর স্ত্রী কুলসুম বিবি (৫০) জানান, তাদের বাড়িতে এক সময়ে ঢেঁকি দিয়ে ধান, চাল ও গমসহ নানা খাদ্য সামগ্রী ভানা হতো। ঢেঁকিই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। ১৯৮০ সালের পর আর ঢেঁকি ব্যবহার করা হচ্ছে না। কুলসুম বিবি জানান, ঢেঁকি সাধারণত রান্না ঘরের এক কোণে বসানো হতো। কুলসুম বিবি নিজেও অন্য নারীদের সঙ্গে ঢেঁকি দিয়ে ধান, চাল ও গম ভানতেন। এখন তার কাছে ঢেঁকি শুধুই স্মৃতি। কুলসুম বিবিদের বাড়িতে এখন আর ঢেঁকি নেই। তবে প্রতিবেশী কাউয়ুম ঢালী ও লিটন ঢালীদের বাড়িতে ঐতিহ্য হিসেবে ঢেঁকি স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। তবে এটি আর ব্যবহার হচ্ছে না। একই গ্রামের হাবিবুর রহমান ঢালী (৫২) জানান, ঢেঁকির কথা এখন আমরা ভুলে গেছি। এখন আমরা বাজারে গিয়ে ধান, চাল, গমসহ নানা উপকরণ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসি। আশির দশকের পর আর ঢেঁকি ব্যবহার হচ্ছে না। শোনাও যাচ্ছে না সেই ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দ। তার মতে ঢেঁকি এখন বিলীন হয়ে গেছে। ঢেঁকি এখন শুধুই কাগজে-কলমে ও স্মৃতির মণি কোঠায় রয়েছে।
×