ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষে সীমান্তে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা

ইচ্ছে হচ্ছিল দাদাকে ছুঁয়ে দেখি...বাধা কাঁটাতার

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৫

ইচ্ছে হচ্ছিল দাদাকে ছুঁয়ে দেখি...বাধা কাঁটাতার

এস এম জসিমউদ্দিন “ইচ্ছে হচ্ছিল, দাদাকে ছুঁয়ে দেখি। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ছুঁতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল দাদাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করি। তাহলে হয়ত দীর্ঘদিনের জমে থাকা কষ্টগুলো থেকে রেহাই পেতাম। এক রক্ত, একই বংশ, তবু কেন আলাদা আমরা? নিজের মানুষকে দেখব, কেন এত জটিলতা? এটা কেন সহজ করা হয় না? এভাবে কথা বলে আমি শান্তি পাই না।” ওপারের সীমান্তে আসা দাদাকে দেখতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নাতনি ওয়াজিফা। ওপারে দাদা আর এপাড়ে নাতনি ওয়াজিফা জাহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে দু’জন দু’জনের সঙ্গে কথা বলছেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে থাকলেও পারছেন না, মাঝখানে যেন অলঙ্ঘনীয় কাঁটাতারের বেড়া।শুধু দাদা ওয়াইজ উদ্দিন আর নাতনি ওয়াজিফাই নন। বুধবার হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বজনদের এক পলক দেখতে ছুটে যান ওই সীমান্তে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বেতনা সীমান্তে নাগর নদীর পাড়ে প্রতিবছরের মতো এবারও বসেছিল দুই বংলার মানুষের মিলনমেলা। বুধবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বসে এ মেলা। কৃষ্ণা ও নিহারিকার ভাই শংকরনাথ থাকেন শিলিগুড়িতে। ভাইয়ের জন্য পিঠা এনেছেন। কথা হলেও নিজের তৈরি পিঠা দিতে পারেননি। তবুও দেখার আনন্দ নিয়ে বিদায় নিলেন তারা। রানীশংকৈল উপজেলার আমজোয়ান থেকে শেফালী দাস এসেছেন ভারতের কাকরমনি গ্রামে থাকা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুভূতি বলতে গিয়ে শেফালী বলেন, বিয়ের দুই বছর পর মাকে দেখলাম। তবে তেমন কথা হয়নি। অসুস্থ মাকে একনজর দেখে এলাম। এখন একটু ভাল লাগছে। হরিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অধীনে ছিল। এ কারণে দেশ বিভাগের পর আত্মীয়স্বজনরা দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারাবছর এদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে পারে না। অপেক্ষা করে থাকে এ দিনটির জন্য। দুই দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা আলাদা করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করে। কিন্তু সে কাঁটাতার আলাদা করতে পারেনি দুই দেশের মানুষের ভালবাসার টানকে। সুযোগ পেলেই তারা ছুটে যায় কাঁটাতারের বেড়ার কাছে, মিশে যান একে অপরের সঙ্গে ভালবাসার দুর্লভ ওমে। অনেকদিন পর আপনজনের দেখা পেয়ে আবেগে কেঁদে বুকের কষ্টটা হালকা করেন অনেকে। বিনিময় করেন মনের জমানো হাজারো কথা। কিন্তু তারা জানে না ভৌগোলিক সীমারেখাকে কবে হৃদয়ের দাবি দিয়ে ছিন্ন করতে পারবে। অনেকদিন পর দেখ, আহা ॥ স্টাফ রিপোর্টার, পঞ্চগড় থেকে জানান, দু’দেশের মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসএফ ও বিজিবি জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অমরখানা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখা সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়। প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখানে আসা লোকজন আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে একে অন্যের হাত স্পর্শ করে আনন্দের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দিদি-দাদু, কাকা, চাচু, আপু-দুলাভাই-জামাইবাবু কেমন আছিস তোরা। অনেকদিন পর দেখা। আহা ! শুকিয়ে কি চেহারা হয়েছে তোর। বাবা-মার শরীর কেমন। তাদের দেখিনি অনেকদিন। পাসপোর্ট-ভিসা করে সামনের পুজোয় আসছি কিন্তু। এ যেন হৃদয়ের মর্মস্পর্শী এক দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া এবং সীমান্ত আইন কোন কিছুই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো আসা দু’বাংলার মানুষের মিলনমেলায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত মানুষ নিজেদের স্বজনকে খুঁজে বের করে কুশল বিনিময় ছাড়াও প্রিয়জনদের সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার সামগ্রী তুলে দেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। বাংলা নবর্ষের নতুন সূর্য উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তের জিরো লাইনে হাজারো মানুষের ভিড় জমে যায়। বেলা বাড়তেই দু’বাংলার লাখো মানুষ জড়ো হয় ব্যতিক্রমী এ মিলন মেলায়। ৪৭ পরবর্তী দেশ ভাগের পর পঞ্চগড় ও আশপাশের জেলার সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত অনেকের আত্মীয়-স্বজন ভারতীয় এলাকায় থেকে যায়। পরবর্তীতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করলে দু’দেশের আত্মীয়-স্বজনদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অর্থের অভাবে পাসপোর্ট ও ভিসা করতে অসমর্থ মানুষ প্রতিবছর নববর্ষের এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
×