ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিতর্ক কতটা যৌক্তিক?

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিতর্ক কতটা যৌক্তিক?

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দ্বিতীয় আসামি জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রতিটি রায়ের পরে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে ঠিক একইভাবে কয়েকটা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থা বিচার প্রক্রিয়ায় নাখোশ হয়ে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছে ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জামায়াত নেতার দণ্ড স্থগিত করার জন্য এবং সম্পূর্ণভাবে মৃত্যুদ- রহিত করার দাবিও তারা জানিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম এবং সর্বাগ্রে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান রাইট ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন। তাদের কার্যকলাপে মনে হয় তারা জামায়াতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, যার ফলে প্রতিটি রায়ের পরেই তারা একই ধরনের অভিন্ন নৈতিক বক্তৃতা জারি করে চলেছে। আর সেটা হলো, ‘বাংলাদেশ সরকার মৃত্যুদ- কার্যকর করা স্থগিত এবং রহিত করে ও দ্রুত এই আদিম অভ্যাস বিলুপ্তকারী ক্রমবর্ধমান দেশের সংখ্যায় যোগদান করা উচিত, ‘বললেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড এ্যাডামস।’ তাঁর ভাষায়, ‘অপরাধের তীব্রতা কোনক্রমেই মৃত্যুদ-ের মতো শাস্তি ক্রমাগত ব্যবহারের জন্য কোন যুক্তি প্রদান করে না।’ বিচার প্রক্রিয়াকে ‘গম্ভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’ অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘একটি স্বাধীন পর্যালোচনা না হওয়া পর্যন্ত অবিলম্বে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা উচিত।’ এপ্রিল ৮ তারিখে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা স্থগিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ‘আমরা দ্রুত জামায়াতে ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। বিচার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি এবং বিচার প্রক্রিয়া ‘আন্তর্জাতিক ন্যায্য বিচারের মান’ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মৃত্যুদণ্ড পুরোপুরি রহিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে সব মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে ‘মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি অপরাধের পুনরায় সংঘটনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবন্ধক নয়।’ মৃত্যুদণ্ড বিশ্বব্যাপী একটি বিতর্কিত বিষয় এবং উভয় পক্ষের যুক্তি সমানভাবে শক্তিশালী। প্রবক্তাদের যুক্তি হলো সমাজে জীবনের মহামূল্যকে অবজ্ঞা করে অন্যদের জীবনকে যারা সম্মান করে না তারা সমাজের সদস্যপদে তাদের নিজস্ব অধিকার বাতিলযোগ্য করে তোলেন। অন্যদিকে যে সমাজে এমনকি বিচার বিভাগ আইনসঙ্গতভাবে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ এবং সেটা নিয়ে তাদের অহঙ্কার করার অনেক কারণ আছে, সে সমাজেও যদি বিচারে কোন অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারণে কোন অভিযুক্তের প্রাণ নেয়া হয় এবং সেটা পরবর্তীতে ধরা পড়ে সেটা আর শোধরাবার কোন পথ থাকে না। তিনটির মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিটি অনেকটা সাধারণ প্রকৃতির। উভয় পক্ষের যুক্তির বাইরেও ঐ সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে কোন অবস্থান নেয়ার পূর্বে। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসকের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সাতজন ছাত্রকে ঠা-া মাথায় হত্যাকারী দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তি যখন যাবজ্জীবন কারাদ- ভোগ করছিলেন তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঐ দণ্ডিতের পিতার সমর্থনের আশায় ঐ সামরিক শাসক তাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেন। ঐ সজাপ্রাপ্ত খুনী এখন সগৌরবে রাজনীতি করে চলেছেন। কয়েক বছর আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক খুনীকে রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেন, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন দেশে কি এই ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি কল্পনা করা যায়? জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি, দুটোই বিশেষভাবে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, উভয় প্রতিষ্ঠানই ৪৪ বছর আগে আমাদের জনগণের ওপর সংঘটিত গণহত্যার অপরাধীদের বিচার এবং দণ্ড, দুটোতেই তাদের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছে। উল্লেখ্য, এই বিবৃতি যেদিন জারি করা হয় সেই দিনই আজিজুল হক বাচ্চু নামের একজন আসামির নাটোরে দু’জন মেয়েকে হত্যার জন্য কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়। তবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বা এইচআরডব্লিউ ‘শুধুমাত্র’ দুটি মানুষ হত্যায় দণ্ডিত বাচ্চুকে নিয়ে কোন উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তাদের উদ্বেগ অন্যান্য অপরাধ ছাড়াও ঠা-া মাথায় গণহত্যার অংশ হিসেবে ১৬৪ জন মানুষকে হত্যায় যিনি অংশগ্রহণ করেন সে অপরাধীর সাজা নিঃশর্তভাবে স্থগিত করার জন্য, যে গণহত্যার বিচার করতে বর্তমান সরকার আমাদের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার বর্বরতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের নাৎসী বাহিনীর পাশবিকতার সঙ্গে তুলনা করেছে আদালত। একাত্তর সালের ২৫ জুলাই ভোরে সোহাগপুর গ্রামের ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়; ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের নারীরা। এক গ্রামে এক সঙ্গে এতজন পুরুষ নিহত হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ নারীকে অকালে বৈধব্য নিতে হয়েছিল বলে সোহাগপুরের নাম হয়ে যায় ‘বিধবা পল্লী’। এ নৃশংসতা জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বা এইচআরডব্লিউ-এর দৃষ্টিতে কোন বড় ব্যাপার নয়! জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উভয়ের আসন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে ৩২টি অঙ্গরাজ্যে এখনও মৃত্যুদ- চালু আছে। একমাত্র ২০১৪ সালে ওখানে ৩৫টি এবং ইতোমধ্যে ২০১৫ সালে ১১টি মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। মৃত্যুদ- কার্যকরের ব্যাপারে বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্রের স্থান চতুর্থ। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৫-এর ১০ মার্চ পর্যন্ত ১৪০৫ মানুষের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সাম্প্রতিক একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের তেষট্টি শতাংশ মানুষ বিশেষ করে গণহত্যা অপরাধীদের মৃত্যুদ- প্রদানের পক্ষে মত দিয়েছে। এমনকি গত ৮ এপ্রিল বস্টন ম্যারাথনে বোমা মারার ট্রায়াল জুরিরা তিনজনকে হত্যার অভিযোগে জোখার সারনেভ নামে একজনকে ৩০টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে যার ১৭টি অভিযোগের শাস্তি মৃত্যুদ-যোগ্য। বিশ্বের কোন সংস্থা এ বিচারের বা সম্ভাব্য মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে কোন সংস্থা কোন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে জানা যায়নি। উভয় প্রতিষ্ঠানই আবিষ্কার করেছে বিচার প্রক্রিয়া ‘গম্ভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে আরও এক ধাপ এগিয়ে আবিষ্কার করেছে অপরাধের তীব্রতা কোনক্রমেই মৃত্যুদ-ের মতো শাস্তি ক্রমাগত ব্যবহারের জন্য কোন যুক্তি প্রদান করে না।’ তবে উভয় সংস্থাই এই ‘গম্ভীরভাবে ত্রুটিগুলো’ কি কি সেটা উল্লেখ করেনি কিংবা তারা তাদের তথ্যের উৎস প্রকাশ করেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে কামারুজ্জামানের ১৬৪ জন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকে ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করে না! আমার সীমিত গবেষণায়, আমি এমন কোন যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সন্ধান পাইনি যার প্রক্রিয়া এত স্বচ্ছ এবং আসামিদের এমনভাবে ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয়। এছাড়াও আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া সবার জন্য উন্মুক্ত। একই সময়ে, নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য অভিযুক্তদের পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দেয়া হয়। প্রসিকিউটরদের সাক্ষীদের একটি তালিকা এবং তাদের রেকর্ড করা বিবৃতি এবং নথিপত্র বিবাদীর আইনজীবীকে সরবরাহ করতে হয় যার ওপর তারা নির্ভর করে তারা তাদের মামলার প্রস্তুতি নিতে পারেন। এছাড়াও আসামিদের আইনজীবীর যে কোন সাক্ষীকে কাঠগড়ায় ডেকে জেরা করার অধিকার সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত। এই সবই নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিফেন রাপ বাংলাদেশ বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য গত কয়েক বছর ধরে কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি গত আগস্ট মাসে ঢাকায় এসে বিচার প্রক্রিয়ার সব গুণাবলী জোরালোভাবে প্রশংসা করেছেন। তার ভাষায় ‘সত্য খুঁজে বের করার বিশ্বের সেরা উপায় হলো প্রমাণ উপস্থাপন করা এবং উভয় পক্ষের সাক্ষীদের জেরা করার সমান সুযোগ ও তাদের যুক্তিকে সমান গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা করা এবং সেই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়াই চলছে বাংলাদেশে।’ এ প্রক্রিয়া আমেরিকান সরকার জোরালোভাবে সমর্থন করেÑ বললেন স্টিফেন রাপ। সমালোচকরা তাদের নিজেদের একটা উপকার করবেন যদি তারা হার্ভার্ড-শিক্ষিত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি বাস লিখিত সম্প্রতি প্রকাশিত অনেক প্রশংসিত এবং অনেক বিখ্যাত পুরস্কারপ্রাপ্ত বই, ‘ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং একটি বিস্মৃত গণহত্যা’ পড়েন তাহলে তারা বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারবেন এবং তারা জানবেন এই আসামিরা বা অভিযুক্ত আসামিরা নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে কিভাবে ঠা-া মাথায় খুন করেছে। লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক
×