ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লোকায়ত সংস্কৃতির উৎসব শেকড়ের সন্ধানে নগর বর্ণিল সাজ সর্বত্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ এপ্রিল ২০১৫

লোকায়ত সংস্কৃতির উৎসব শেকড়ের সন্ধানে নগর বর্ণিল সাজ সর্বত্র

মোরসালিন মিজান পুরনো হলো আরও একটি বছর। এখন বিদায় নেয়ার পালা। আগামীকাল সোমবার কালের গর্ভে হারাবে ১৪২১ বঙ্গাব্দ। নানা আনুষ্ঠানিকতায় পুরনো বছরকে বিদায় জানাবে বাঙালী। সেই সঙ্গে বরণ করে নেবে ১৪২২ বঙ্গাব্দকে। বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষে এখন উৎসবমুখর রাজধানী ঢাকা। ধর্ম-বর্ণের ভেদ নেই। সকল নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো যার যার মতো ব্যস্ত। ঘরে ঘরে চলছে উৎসব উদ্যাপনের প্রস্তুতি। সোমবার বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি। এক সময় বর্ষ বিদায়ের এই দিনে থাকত সবচেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিকতা। কিছু এখনও বর্তমান। রাজধানীতে নানা আয়োজনে বিদায় জানানো হবে পুরনো বছরকে। এদিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হবে বর্ণাঢ্য চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় উৎসবের আয়োজন করছে সুরের ধারা। আয়োজকদের পক্ষে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা জানান, অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা থেকে। চলবে রাত ১২টা ৫ মিনিট পর্যন্ত। গানে গানে শিল্পীরা ১৪২১ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানাবে। একই দিন সন্ধ্যায় চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। নাট্য সংগঠনের আয়োজন হলেও, এতে যোগ দেবেন সঙ্গীত-নৃত্য-আবৃত্তিসহ বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। লোকজ আচার অনুসরণ করে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন ফেডারেশনের সহসভাপতি ঝুনা চৌধুরী। এর আগে বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজন করা হবে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের। উৎসবের আহ্বায়ক ড. আবুল আজাদ জানান, আয়োজনের পুরোটাই থাকবে লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা, গান ও কবিতা পাঠ। মিলনায়তনের বাইরে আয়োজন করা হবে পটচিত্র প্রদর্শনীর। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব আয়োজন করা হবে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। বলা বাহুল্য, বর্ষ বিদায়ের পরের দিনটি বর্ষ বরণের। অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর এটি এখন সবচেয়ে বড় এবং বর্ণিল উৎসব। সঙ্গত কারণে অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। এখন শেষ পর্যায়। বর্ষ বরণ উৎসবের আলোচনায় প্রথমেই আসে ছায়ানটের নাম। বহুকালের ধারাবাহিকতায় সংগঠনের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখ সকালে রমনা বটমূলে আয়োজন করা হবে বর্ষ বরণ উৎসবের। এবার ৪৭তম আয়োজন। সাম্প্রতিক সময়টি বিবেচনায় রেখে উৎসবের প্রতিপাদ্য করা হয়েছেÑ শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার। আয়োজক সূত্র জানায়, এবারও রমনা বটমূলে প্রস্তুত হচ্ছে বিশাল মঞ্চ। এ মঞ্চে পাঁচ সারিতে বসবেন ১৩০ জনের মতো কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। সম্মেলক পরিবেশনায় অংশ নেবেন ৯৫ জন গায়ক-গায়িকা। ছায়ানটের চতুর্থ ও পঞ্চাম সমাপনী বর্ষের বাছাইকৃত শিক্ষার্থীরা গাইবে। থাকবে প্রারম্ভিক শিশু প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন খায়রুল আনাম শাকিল, মিতা হক, লাইসা আহমদ লিসা, চন্দনা মজুমদার, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, সুকান্ত চক্রবর্তী, সিফায়েতউল্লাহ মুকুল, বিমান চন্দ্র বিশ্বাসসহ ১৩ জন। দুই ঘণ্টাব্যাপী আয়োজনে মোট ২৬টি গান পরিবেশিত হবে। সম্মেলক পরিবেশনা ১২টি। ১৩টি একক পরিবেশনা। যথারীতি থাকবে জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ার বিশেষ একটি পর্ব। আয়োজক সূত্র জানায়, নববর্ষ আবাহন শুরু হবে সেতার বাঁধনের মধ্য দিয়ে। ১৪ মিনিটের প্রভাতী রাগ শেষে শুরু হবে সম্মেলক পরিবেশনা। থাকবে একক গানও। প্রথমেই শিল্পীরা গাইবেনÑ ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী, এখানে থেমো না...। বাকি গানগুলোও সুনির্বাচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও, নজরুল লালন সলিল চৌধুরী ও রশিদউদ্দীনের গান গেয়ে বরণ করে নেয়া হবে নববর্ষকে। তবে বিশেষ করে বলতে হয় ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটির কথা। হ্যাঁ, বহু বছর এই গানটি গাওয়া হয়নি ছায়ানটের উৎসবে। এবার সে গান যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবেন আবদুস সবুর খান চৌধুরী ও লিয়াকত খান। সমকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন। ছায়ানটের বর্ষ বরণ উৎসব শেষ হওয়ার পর পরই শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এই আয়োজন এখন বর্ষ বরণ উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। প্রস্তুতিও ব্যাপক। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল। এখন শেষ পর্যায়ে। শনিবার চারুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, উৎসবের আমেজ। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একত্রে কাজ করছেন। জয়নুল গ্যালারির সামনের খোলা জায়গায় টেবিল সাজিয়ে বসেছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকেই ব্যস্ত ছবি আঁকায়। শিক্ষকরাও তেল রং, জল রঙে ছবি আঁকছেন। বাকিরা মাটির সরায় আঁকছেন লোকায়ত জীবনের ছবি। পাশেই চলছে মুখোশ বানানোর কাজ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়েই আয়োজন করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারও শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থাকবে বিশালাকৃতির ভাস্কর্য। চারুকলার লিচুতলায় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কাঠামো। ইতোমধ্যে আপন চেহারা পেয়েছে মাছ, পাখি, হাতিসহ ৮টি ফোক মোটিভ। মঙ্গল শোভাযাত্রার খুঁটিনাটি তুলে ধরে অনুষদের ডিন শিল্পী নেসার আহমদ বলেন, এবার আমাদের আয়োজন একটু বেশি। কয়েক শ’ ছেলেমেয়ে কাজ করছে। শিক্ষকরাও তাদের সঙ্গে আছেন। তিনি বলেন, প্রতিবারের মতোই লোকজ সংস্কৃতিকে সামনে রাখব আমরা। ওখানেই আমাদের মূল শক্তি। লোকসংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান কোন কালেই ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, এই সংস্কৃতি মানুষের। বিভাজনের নয়। এক করার। বর্তমান সময়ের কিছু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। এ জন্য প্রচুর কাজ করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই এবারের প্রতিপাদ্যÑ ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’। আগামীকাল সোমবারের মধ্যে প্রস্তুতির পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানান তিনি। এসবের বাইরেও সারা শহরে থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। লাল-সাদা পোশাকে সেজে এসব অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন নগরবাসী।
×