ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম জিয়ার আন্দোলন ও তাঁর পাপের বোঝা

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১২ এপ্রিল ২০১৫

বেগম জিয়ার আন্দোলন ও  তাঁর পাপের বোঝা

বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামক দেশে যে বড় রাজনৈতিক দলটি আছে তাদের ইদানীংকালের কর্মকা- দেখলে ভারতীয় বাংলা টিভি জি-বাংলা বা স্টার জলসায় অবিরাম চলমান সিরিয়ালগুলোর কথা মনে পড়ে। এইসব সিরিয়ালে সব সময় দেখা যায় একান্নবর্তী পরিবারের এক ডজন মহিলা সব সময় সেজেগুজে থাকেন এবং সর্বক্ষণ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর ছেলেরা হচ্ছে অনেকটা হাবাগোবা, সব সময় বাড়ির ষড়যন্ত্রপ্রিয় মহিলাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে এক পায়ে খাড়া। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়াকে এই রকম সিরিয়ালে একটি যুতসই চরিত্র দিলে বেজায় মানাত তার বড় প্রমাণ গত ৩ জানুয়ারি হতে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ ৯২ দিনের কর্মকা-। এই কর্মকা-ে তাঁর সঙ্গে অন্য কোন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন কি না জানি না, তবে লন্ডনে পলাতক তাঁর নাদান আর নালায়েক বড় ছেলে তারেক রহমান বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছেন। নিজ বাসগৃহ ছেড়ে অফিসে উঠেছিলেন বেগম জিয়া ৩ জানুয়ারি। আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ৫ তারিখ তিনি ও তাঁর ২০ দলীয় জোট নয়াপল্টনের দলীয় অফিসের সামনে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালন করবেন। কারণ এক বছর আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মতে তাতে অংশগ্রহণ করেননি। কারণ তাঁদের দাবি অনুযায়ী সরকার অসাংবিধানিক উপায়ে সংসদ নির্বাচন করতে রাজি হয়নি। শেখ হাসিনা অনেক চেষ্টা করেছেন তাঁদের নিয়ে নির্বাচন করতে। ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে নিজে অপমানিতও হয়েছেন। বেগম জিয়া শুধু নির্বাচন বর্জনই করেননি, তা প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাচন যথাসময়ে হয়েছে, নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্র জামায়াত-শিবিরের হাতে প্রায় ২০০ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য শুধু যে বেগম জিয়া বা তাঁর মিত্ররা চেষ্টা করেছেন তা নয়, তাঁদের অনেক আন্তর্জাতিক মুরব্বি, কিছু তাঁবেদার সুশীল সমাজ আর মিডিয়াও আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। সরকারী দলের অনেক নেতার মাঝেও সন্দেহ ছিল এই নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু একজন শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি হয়েছিল। একই দিন অর্থাৎ গত ৫ জানুয়ারি সরকার ঢাকাসহ সারাদেশে ‘গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা’ দিবস পালনের ঘোষণা অনেক আগে দিয়ে রেখেছিল। একই দিন ঢাকার মতো একটি শহরে পরস্পরবিরোধী দুটি জনসভা বা সমাবেশ হলে তা ২০১৩-এর ৫ মের হেফাজত সৃষ্ট একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারত। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমতাবস্থায় একই সময়ে এই রকম দুটি সভা করতে দিতে অস্বীকার করে, যা বেগম জিয়া মেনে নিতে পারেননি। প্রশাসন বিএনপি ও তাদের মিত্রদের এই সমাবেশের অনুমতি না দেয়া সত্ত্বেও বেগম জিয়া বিকেল ৫টায় তাঁর অফিস থেকে বের হয়েছিলেন সমাবেশে যাবেন বলে। পরে জানা যায় তিনি আসলে ঠিক করেছিলেন ওই রাত থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান করবেন এবং সেখানে বসে সরকার পতনের নামে ‘জনতার মঞ্চ’ আদলে একটি আন্দোলন শুরু করবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা আগে হতে আঁচ করতে পেরে বেগম জিয়াকে তাঁর দফতর থেকে বের হতে দেয়নি। অফিসের সামনে বালির ট্রাক রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে বেগম জিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে অনেকটা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ঘোষণা করেন সরকারের আচরণের প্রতিবাদে তিনি সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডাকছেন। তাঁর যদি সামান্যতম রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকত তাহলে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন তাঁর এই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তথাকথিত আন্দোলন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার মতো সক্ষমতা তাঁর দল এবং অন্যান্য ওয়ানম্যান পার্টিগুলোর নেই। ক’দিন না যেতেই তাঁর অবরোধের সঙ্গে যোগ হলো হরতালের নামে ভয়াবহ সন্ত্রাস আর নাশকতা। এই ধ্বংসযজ্ঞে বিএনপি আর ছাত্রদলের সঙ্গে শামিল হয়েছিল জামায়াত-শিবির। আসলে বিএনপি বা বেগম জিয়ার গণআন্দোলন করার অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। তিনি বুঝতে চান না কোন আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে সেই আন্দোলন সফল করা অসম্ভব। এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন বেগম জিয়া। সেটি আসলেই একটি গণআন্দোলন ছিল। কিন্তু তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা না থাকাতে সেই আন্দোলন ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ না যোগ দিয়েছে। শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়া এক সঙ্গে বসলেন, আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করলেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন আর সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সঙ্গে থাকল শ্রমিকদের সমন্বয়ে গঠিত স্কপ, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, আন্দোলনরত সব দল ও গোষ্ঠীর কর্মীরা। যার ফলে গড়ে উঠেছিল জনতার ঐক্য। সেইরকম ঐক্য না হলে কখনও কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। তা যখন হয় না তখন যারা আন্দোলন আন্দোলন খেলে তারা অনেক সময় নানামুখী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়, যা বিএনপি তথা ২০ দলীয় ঐক্যজোটের ক্ষেত্রে এবার দেখা গেছে। যার অন্যতম উদাহরণ মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে নিউইয়র্ক প্রবাসী বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার টেলিফোন সংলাপ। বেগম জিয়া জানুয়ারির ৫ তারিখ দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দিয়ে অফিসে শয্যা নিলেন। বললেন তাঁর দাবি অর্থাৎ বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, অসাংবিধানিক নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে বর্তমান সরকারের বিদায় নেয়ার পর তিনি তাঁর দফতর হতে বের হবেন। এর মধ্যে তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর লাশ ঢাকায় আনা হলে বেগম জিয়া একবার তাঁর দফতরের ওপরতলা থেকে নিচে নেমে লাশ দেখে আবার উপরে উঠে যান। লাশ দাফন করার দু’দিনের মাথায় তিনি তাঁর পুত্রবধূ ও দুই নাতনিকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেন। কারণ তাদের স্কুল খোলা এবং সামনে পরীক্ষা। অথচ দেশে তখন পনেরো লাখ শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক পরীক্ষাকে জিম্মি করে তিনি তাঁর ক্ষমতায় যাওয়ার ‘আন্দোলন’ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শহরগুলোর হাজার হাজার স্কুল-কলেজ নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ তাঁর এই তথাকথিত আন্দোলন ছিনতাই করে জামায়াত-শিবির দেশে পেট্রোলবোমা সংস্কৃতি চালু করে দিয়েছে। দিনরাত পুড়িয়ে মারছে অথবা চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিচ্ছে শত শত মানুষকে। বাদ যাচ্ছে না দু’বছরের শিশু থেকে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও। সে এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে এমনকি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পর্যন্ত চুপ থাকতে পারেনি। ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ এ্যামনেস্টি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘These are criminals act for political purpose. Whoever is doing them are criminals and have to be brought to justice.’ শিরোনামে ছিল ‘The Amnesty International has condemned the frequent incidents of arson and firebombing of vehicles in Bangladesh during the BNP-led coalition’s ongoing agitation.’ এর মর্মার্থ হচ্ছে ‘নাশকতাকারীরা অপরাধী। বিএনপি-জোটের চলমান বিক্ষোভ কর্মসূচীর কারণে নিয়মিত যে অগ্নিবোমা সন্ত্রাস চলছে তা নিন্দনীয় অপরাধ এবং তার জন্য যারা দায়ী তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে।’ বিবৃতিটি বেশ দীর্ঘ। কোকোর মৃত্যুর পর বেগম জিয়া আরও দু’বার জনসম্মুখে এসেছিলেন। দু’বারই সাংবাদিকদের ব্রিফিং করার জন্য। ব্রিফিং এই কারণেই তিনি সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জবাব দেন না। তিনি কারও একজনের লেখা বিবৃতি পাঠ করে উঠে যান। এই দু’বারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রথমবার বলেছিলেন আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলে তারপর তিনি ঘরে ফিরবেন। দ্বিতীয়বার বললেন, এই আন্দোলনের ‘যৌক্তিক পরিণতি’ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজ ঘরে ফিরছেন না। তারপর হঠাৎ কী হয়ে গেল, তিনি গত রবিবার তাঁর স্বেচ্ছাঅন্তঃপুরবাসিনী অবস্থান ত্যাগ করে নিজের দু’টি দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দিতে বিশেষ আদালতে গেলেন এবং সেখান থেকে নিজ ঘরে ফিরলেন। আসলে এটাই ছিল তার ‘যৌক্তিক পরিণতি’। কারণ তিনি তথাকথিত যে আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন তার সমাপ্তি টানার আর কোন বিকল্প ছিল না। তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন তাঁর এই ‘আন্দোলনের’ সঙ্গে দেশের মানুষ দূরে থাকুক নিজ দল বা তার জোটের কোন নেতাকর্মীও নেই। মাঝখানে জামায়াত-শিবির দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নির্বিচারে মানুষ মারছে আর সকল দায়-দায়িত্ব বর্তাচ্ছে তাঁর দলের ওপর, যদিও মাঝপথে এই যুদ্ধে ছাত্র ও যুবদলের বেশকিছু নেতাকর্মীও শামিল হয়েছিল। সরকারী দলের কিছু অপরিণামদর্শী কর্মীও অর্থের লোভে তাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছে। সুতরাং বেগম জিয়ার যৌক্তিক পরিণাম হচ্ছে শূন্য হাতে ঘরে ফেরা আর দলকে একটি নাজুক অবস্থায় ঠেলে দেয়া। বেগম জিয়ার এই ৯২ দিনের ‘আন্দোলনে’ লাভবান হয়েছে তাদের অবিচ্ছেদ্য মিত্র জামায়াত। তারা অবরোধ, হরতালসহ নানা অজুহাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ দীর্ঘায়িত করতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকারী কৌঁসলিরা সময়মতো সাক্ষী হাজির করাতে পারেননি। অনেক সময় ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের কৌঁসলিরা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে হাজির হননি। এই সুযোগে জামায়াত সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের সন্ত্রাসীদের সংগঠিত করতে পেরেছে। এই ফাঁকে তারা বিএনপির কিছু কর্মীকে সন্ত্রাসী বানাতে পেরেছে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে- বেগম জিয়া নিজ ঘরে ফিরেছেন সত্য, সঙ্গে নিয়ে গেছেন অগ্নিদগ্ধ অসংখ্য মানুষের অভিশাপ, যার ভার হয়ত তাঁকে আজীবন বইতে হবে। এই ৯২ দিনে বেগম জিয়ার পাপের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে। কথায় বলে পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। ১০ এপ্রিল, ২০১৫ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষকৎ
×