ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : আইয়ান হিরসি আলী;###;অনুবাদ : এনামুল হক

ইসলাম সংস্কারক বনাম ধর্মান্ধ মুসলমান

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১১ এপ্রিল ২০১৫

ইসলাম সংস্কারক বনাম ধর্মান্ধ মুসলমান

মুসলিম বিশ্বে আজ যে টালমাটাল অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা শুরু স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সৃষ্টি হয়নি এবং এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পরিণামে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট ব্যর্থতা ও দারিদ্র্য থেকেই শুধু উদ্ভূত হয়নি। বরং বলা যায়, বহুলাংশে খোদ ইসলামের কারণে এবং আধুনিকতার সঙ্গে ইসলামের বিশেষ মৌলিক শিক্ষার অসঙ্গতি থেকেও এই অবস্থার উৎপত্তি। সেজন্যই আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় সংঘাতগুলো একদিকে যারা এই সকল অসঙ্গতি টিকিয়ে রাখতে এমনকি বাড়িয়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং অন্যদিকে যারা ইসলামকে উৎখাত করা নয় বরং সংস্কার করার লক্ষ্যে ওই শ্রেণীর লোকদের সাহসিকতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত তাদের মধ্যেই সংঘটিত হচ্ছে। ‘চরমপন্থী’ ও ‘মধ্যপন্থী’ মুসলমানদের মধ্যেকার স্থূ’ল পার্থক্যটা ভুলে যান। আমাদের বরঞ্চ তিন শ্রেণীর মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য টানতে হবে। প্রথম শ্রেণীর মুসলমানরাই অধিকাংশ সমস্যার জন্য দায়ী। এই শ্রেণীর মুসলমানরা শরিয়া বা ইসলামী ধর্মীয় আইন ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার কথা ভাবে। তাদের লক্ষ্য মহানবী মুহম্মদ (দ)-এর শিক্ষাবলীকে পালন করাই শুধু নয়, উপরন্তু মদিনা গমনের পর মহানবী (দ) যেসব সামরিক ব্যবস্থা বা কর্মকা- চালিয়েছিলেন সেগুলোও অনুকরণ করা। নিজেরা সহিংস কার্যকলাপে লিপ্ত না হলেও এই শ্রেণীর লোকেরা সহিংসতাকে মার্জনা করতে দ্বিধা করে না। দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমানরাই হলো গোটা মুসলিম বিশ্বের সুস্পষ্ট সংখ্যাগুরু অংশ। এরা ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতি অনুগত এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগী করে থাকে। তবে তারা সহিংসতার চর্চা করতে বা সহিংসতার কথা প্রচার করতে আগ্রহী নয়। ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টান বা ইহুদীরা যারা প্রতি সপ্তাহে উপাসনালয়ে যায় এবং খাওয়া দাওয়া ও পোষাক আষাকে ধর্মীয় বিবিবিধান মেনে চলে তাদের মতো এই শ্রেণীর মুসলমানরাও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কখনও কখনও এই শ্রেণীর কিছু সদস্যকে ভুলবশত ‘মডারেট’ অ্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। তৃতীয় শ্রেণীতে রয়েছে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ যাদের ইসলামের মধ্যেই জন্ম কিন্তু তারা যে ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে বেড়ে উঠেছে সেটি সম্পর্কে সমালোচনাধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার চেষ্টা করে। এরা হলো মুসলিম বিরুদ্ধবাদী। আমরা অল্পকিছু মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে এই উপসংহারে পৌঁছতে বাধ্য হয়েছি যে, আমরা আর ঈমানদার হিসেবে থাকতে পারব না। তথাপি আমরা ইসলামের ভবিষ্যত নিয়ে বিতর্কে গভীরভাবে নিয়োজিত রয়েছি। তবে বিরুদ্ধবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো সংস্কারবাদী ইমানদার, যারা এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে, ইসলামের অনুসারীদের যদি সহিংসতার সীমাহীন চক্রে নিপতিত হতে না হয় তাহলে তাদের ধর্মের অবশ্যই পরিবর্তন ঘটতে হবে। প্রথম শ্রেণীর মুসলমানরা অর্থাৎ ধর্মান্ধ ইসলামপন্থীরা প্রত্যেকের কাছেই হুমকি। পাশ্চাত্যে এই শ্রেণীটির অস্তিত্বের অর্থ হলো এদের কারণে সন্ত্রাসের ঝুঁকি শুধু বৃদ্ধিই পায় না, উপরন্তু নারীবাদী এবং লিঙ্গ সমতা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমকামী অধিকারের মতো সংখ্যালঘু অধিকারের জন্য আন্দোলনকারীদের কষ্টার্জিত যা কিছু অর্জন সেগুলোও সূক্ষ্মভাবে হারিয়ে যায়। শুধু ইউরোপে নয়, উত্তর আমেরিকাতেও এই হুমকি বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপারটা কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে বুঝতে হবে, তিনি অভিবাসন এবং মুসলমান অভিবাসীদের মনোভাব বিষয়ক তথ্য-উপাত্তগুলো দেখেননি। তবে ধর্মান্ধরা মহানবী (দ)-এর যুগে সহিংস পন্থায় ফিরে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখে সেটা একই ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের জন্য আরও বড় হুমকি। এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব মুসলমান শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করতে চায় তাদের অবস্থানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। আরও মন্দ ব্যাপার হলো তারা বিরুদ্ধবাদী ও সংস্কারপন্থীদের জীবনের প্রতিও সর্বক্ষণ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা হচ্ছি সেই শ্রেণীর মুসলমান যারা সমাজচ্যুত ও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্মুখীন, যাদের সব ধরনের অপমান-অবমাননা সহ্য করতে হবে, যাদের গুম-প্রাণনাশের হুমকির মোকাবেলা করতে কিংবা খোদ মৃত্যুরই মুখোমুখি হতে হবে। পাশ্চাত্যের নীতিনির্ধারকরা আজ ‘ইসলামোফোবিয়া’য় অভিযুক্ত হওয়াকে এতই ভীতির চোখে দেখে যে, তারা সাধারণত মুসলিম সংস্কারকদের ধারেকাছে ভেড়ে না। তারা বরং ‘মডারেট ইসলামের’ স্বঘোষিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে হৃদ্যতা বজায় রাখবে। অথচ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, এরা আর যা কিছুই হোক না কেন মডারেট নয়। এই কারণে আমাদের নেতারা মুসলমানদের সংস্কারের সুযোগটা হাতছাড়া করে ফেলছে। পাশ্চাত্যের সরকারগুলোকে বলা হয় ‘ধর্মীয় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করা আপনাদের কাজ নয়।’ তাই পাশ্চাত্যের নেতারা তাদের কয়েক দশকের পুরাতন আপ্তবাক্যটাই আঁকড়ে থাকে যে, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের সময় কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেননি ‘কমিউনিজম শান্তির আদর্শ।’ কেউ বলেননি ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন যথার্থ কমিউনিস্ট নয়।’ বরং যারা ভেতর থেকে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখিয়েছিল সেই আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন, আঁদ্রে শাখারভ ও ভ্যাকলাভ হ্যাভেলের মতো বিরুদ্ধবাদীদের পাশ্চাত্য প্রশংসা করেছিল ও সমর্থন দিয়েছিল। আজ ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে থাকা অনেক বিরুদ্ধবাদী আছেন। অথচ পাশ্চাত্য হয় তাদের উপেক্ষা করে নয়ত ‘প্রতিনিধি পর্যায়ের নয়’ বলে তাদের উড়িয়ে দেয়। এ এক মস্তবড় ভুল। আসরা নোমানি, ইরশাদ মানজি, তৌফিক হামিদ, মাজিদ নেওয়াজ জুহাদি জাসের, সেলিম আহমেদ, ইউনিস কানদিল, সাইরান আতিস, বাসাম তিবি এবং আবদুল হামিদ আল-আনসারীর মতো সংস্কারকরা আছেন যাদের অবশ্যই সমর্থন ও নিরাপত্তা দেয়া প্রয়োজন। কয়েক প্রজন্ম আগে সোলঝেনিৎসিন, শাখারভ ও হ্যাভেল যেমন পাশ্চাত্যে সুপরিচিতি লাভ করেছিলেন, এই সংস্কারকদেরও তেমনিভাবে পাশ্চাত্যে সুপরিচিত করে তোলা উচিত। সংস্কারকদের কাজ অত সহজ হবে না। সোভিয়েত বিরুদ্ধবাদীদের কাজটাও সহজ ছিল না। তেমনিভাবে প্রোটেস্টান্ট সংস্কারকদের কাজও সহজ ছিল না। তবে প্রেসিডেন্ট ওবামা যেটাকে ‘হিংসাত্মক উগ্রবাদ’ আখ্যা দিয়েছেন সেই সমস্যার সমাধানে মুসলমানদের সংস্কারই হলো সর্বোত্তম পন্থা। রূঢ় বক্তব্যের পরিবর্তে কোমল বক্তব্য পরিবেশনের দিন শেষ হয়েছে। সুদীর্ঘকাল পর অবশেষে ইসলামের সংস্কারের সময় আজ সমাগত। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট [লেখিকা হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল অব গবর্নমেন্ট-এ ফিউচার অব ডিপ্লোমেসি প্রজেক্টের ফেলো, আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো এবং এএইচএ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘হেরেটিক : হোয়াই ইসলাম নিডস্্ রিফর্মেশন নাউ’]
×