ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলা

RAB-এর ৩ কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৯ এপ্রিল ২০১৫

RAB-এর ৩ কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট

রুমন রেজা, নারায়ণগঞ্জ ॥ চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের মামলায় দীর্ঘ ১১ মাস পর পলাতক নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে পলাতক হিসেবে র্যাবের ৮ সদস্যসহ ১৩ জনকে দেখানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুলের সঙ্গে আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তিসহ বিভিন্ন বিরোধকে কেন্দ্র করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে অভিযুক্ত র্যাব সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডলের দাখিল করা প্রসঙ্গে তিনি (নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার দায়ের করা মামলা থেকে ৫ জনকে অব্যাহতি এবং পলাতক নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা ছাড়াই অভিযোগপত্র দাখিল করায় তিনি অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে আদালতে না-রাজী দেবেন। জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের শিবু মার্কেট এলাকা থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ৩ তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে শরীরে ইট বাধা অবস্থায় তাদের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ফতুল্লা মডেল থানায় নূর হোসেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেনকে অভিযুক্ত করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। অপরদিকে নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপরই সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাবাসী ও নারায়ণগঞ্জ বারের আইনজীবীরা ঘটনার জন্য নূর হোসেনকে ও র্যাব-১১ এর উর্ধতন তিন কর্মকর্তাকে দায়ী করে আন্দোলনে নামে। এলাকাবাসী কয়েক দফা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ রাখে এবং অন্যদিকে আইনজীবীরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ ও আদালত বর্জন শুরু করে। অভিযুক্ত র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে প্রথমে নিজস্ব বাহিনীতে ফেরত নেয়ার পর তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে তাদেরকে ৭ খুনের ঘটনায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা হত্যকা-ের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দেন। তাদের জবানবন্দীতে র্যাব-১১ অন্য সদস্যদের সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে এলে তাদেরও পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হয়। তারাও ৭ খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করেন। এ ঘটনায় র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ সদস্য এবং নূর হোসেনের ৫ সহযোগীসহ মোট ২২ জন গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন। এদিকে বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ ম-ল দীর্ঘ ১১ মাস তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমের আদালতে ভারতের কারাগারে আটক নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এমএম রানাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর মধ্যে পলাতক র্যাবের ৮ সদস্যসহ ১৩ জনকে দেখানো হয়েছে। র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছাড়া কারাগারে আটক অভিযুক্ত অন্যরা হচ্ছে, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, বাবুল হাসান, আরজিওয়ান আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, বিল্লাল হোসেন, রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান নূর। অভিযুক্ত নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলোÑ মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম ফজলুর রহমান জানান, আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ৭ খুনের ঘটনায় নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোপত্র দাখিল করেছে। আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানির আগামী ১১ মে ধার্য করেছে। এ মামলায় সাক্ষী হয়েছে ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ১৬২টি বিভিন্ন ধরনের আলামত দুটি বস্তায় ভরে আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার ও এজাহারে অভিযুক্তদের মধ্যে ১৬ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন জানান, আমরা অভিযোগত্রের অনুলিপি সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে বাদীর মতামত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এদিকে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি অভিযোগপত্র দাখিলের খবর পেয়ে আদালতে ছুটে আসেন। তিনি কাউন্সিলর নজরুলসহ ৫ জনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় তার মামলার এজাহারভুক্ত ৬ আসামি থেকে নূর হোসেন ছাড়া বাকি ৫ জনকে অব্যাহতি দেয়ায় ক্ষোভ করেন। তিনি বলেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অভিযোগপত্র প্রদান করা ঠিক হয়নি। কারণ নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে, এ হত্যাকা-ের পরিকল্পনার সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত ছিল। তিনি অভিযোপত্র পর্যালোচনা করে আদালতে না-রাজী প্রদান করবেন। এদিকে সন্ধ্যা ৭টায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়ে সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, আলোচিত ৭ খুনের মামলাটি তদন্তের জন্য ১১ মাস খুব বেশি সময় নয়, আবার কমও নয়। নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব ও ত্রুটিমুক্তভাবে অভিযুক্ত প্রণয়ন করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে দোষী কাউকে বাদও দেয়া হয়নি। আবার অহেতুক কাউকে জড়ানোও হয়নি। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সবকিছু করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ৩৫ জনের মধ্যে ২২ জনকে ইতোমধ্যে আদালতে সোর্পদ করা হয়েছে। ১৩ জন পলাতক রয়েছে। কেন এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো হয়েছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের প্রভাব প্রতিপত্তিসহ বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্ব ছিল। এ জের ধরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অভিযুক্ত র্যাব সদস্যদের দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তবে হত্যাকান্ডে RAB কর্মকর্তার সঙ্গে নিহত নজরুলের পরিবারের ৬ কোটি টাকা চুক্তির ভিত্তিতে খুনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে টাকার পরিমাণ সর্ম্পকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পলাতক ১৩ জনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আদালত নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×