ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৯ এপ্রিল ২০১৫

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

(২ এপ্রিল প্রকাশের পর) ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনের ফলে যে আদর্শ গড়ে উঠেছিল এবং যারা এর চর্চা করেছিলেন তাদের সামনে সৃষ্টি হয়েছিল আদর্শগত বেশকিছু সমস্যার। এর মধ্যে প্রধান ছিল স্ববিরোধিতা। এক পর্যায়ে যিনি ‘প্রগতিশীল’ পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় তিনিই হয়ে উঠছেন রক্ষণশীল। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও ছিল সংঘাত এবং মনে হয় সে কারণেই মূলত ব্যক্তি বিকশিত হতে পারেনি পুরোপুরি। ঐ একই কারণে আমরা দেখি, ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনে যুক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে বা ধর্মকে আধুনিক করে তোলার জন্য [এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে গ্রামে বা মফস্বলে ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবী হিসেবে মোল্লা মৌলবী বা পুরোহিতদের প্রভাব অনস্বীকার্য। তারা যে শিক্ষা দেন প্রাথমিক অবস্থায় বা মনের গড়নে প্রভাব বিস্তার করে থাকে আজীবন]। পাশ্চাত্য অভিঘাতের ফলেই বুদ্ধিজীবীরা ইউরোপীয় আদর্শের আলোকে সব ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইউরোপীয় আদর্শ উপনিবেশে এসে দিক হয়ে গিয়েছিল। প্রায় সবকিছুই তখন দেখার তেষ্টা হয়েছিল ধর্মের আলোকে এবং বোধহয় সে কারণেই এ অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে বিকশিত হয়নি ধর্মনিরপেক্ষতা। বরং যারা বুদ্ধির চর্চা করেছেন, তারা জীবনে কোন না কোন পর্যায়ে আঁকড়ে ধরেছেন ধর্মকে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান বা ভারতবর্ষেও এর তেমন পরিবর্তন হয়নি। ভারতীয়রা কংগ্রেস আমলে তবুও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। পাঠ্যপুস্তকে উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম বিজেপি আমল থেকে আবার হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন হয়েছে। তবে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী পক্ষটিও শক্তিশালী। তারা এ ঝোঁক প্রতিরোধে চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানে পাকিস্তানবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক জাতিগঠন, সাম্প্রদায়িকতা, সামরিকায়ন। পশ্চিম পাকিস্তান তা সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছিল, পূর্ববঙ্গে নয়। সে বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। ৩ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সব সময় ইতিহাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে। এটি করতে চেয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল, সরকার এবং বিশেষ আদর্শে বিশ্বাসী লেখক/ঐতিহাসিকরা। এর একটি কারণ, সোশ্যাল মবিলাইজেশন বা সামাজিক সংগঠিত সমাবেশের ক্ষেত্রে ইতিহাস একটি ভূমিকা পালন করতে পারে, ক্ষমতায় যাওয়ার পটভূমি তৈরি করতে পারে যা পরে দিতে পারে ক্ষমতার বৈধতা। দু-একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের আগে ভারতে মুসলমান নেতৃবৃন্দ সামাজিক সংগঠিত সমাবেশ ঘটনোর জন্য ইতিহাসের সূত্রগুলো তুলে ধরতে চেয়েছেন। তারা মুসলমান নৃপতিদের কথা তুলে ধরেছেন যারা শৌর্যে বীর্যে ছিলেন অতুলনীয় এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন ভারতীয় মুসলানরা তাদেরই বংশধর। ইসলামী শাসনের যুগ স্বর্ণ যুগ। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের [কংগ্রেস] চক্রান্তে আজ তারা হীনাবস্থায়। এই হীনাবস্থা থাকবে না যদি মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়। অবশ্য, অর্থনীতির বঞ্চনাটাই ছিল মূল প্রতিপাদ্য। ইতিহাসের এই ব্যবহার মুসলমান তরুণদের সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে এবং পাকিস্তান মানসিকতা তৈরি করেছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে পাকিস্তান : মুসলমান। ভারত : হিন্দু। এই মানসিকতা গঠন এত তীব্র ছিল যে এর রেশ এখনও মুসলমানদের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। হয়ত এ কারণে শরৎ বসু সোহরাওয়ার্দীর স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব গুরুত্ব পায়নি। [হারুন-অর-রশীদ, ফরশ্যাডোয়িং অফ বাংলাদেশ, বেঙ্গল মুসলিম লীগ এ্যান্ড পলিটিকস, ঢাকা, ২০০৩]। মুসলিম লীগ সফলভাবে ইসলামী মিথ ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান হওয়ার পরও শাসকরা ইতিহাসের ক্ষেত্রে একই নীতির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে আমরা যারা পড়াশোনা করেছি তাদের মধ্যে এই বোধই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। যেমন, দশম শ্রেণীর পাঠ্য পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টিতে ‘খিলাফত আন্দোলন, লক্ষেèৗ চুক্তি ও অসহযোগ আন্দোলন’ অধ্যায়ের উপসংহারে দেখানো হয়েছে, জিন্নাহ কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, খিলাফত আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন [অর্থাৎ তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদেই বিশ্বাস করতেন] ‘‘কিন্তু এই আন্দোলন চলাকালেই তাঁহার জ্ঞানোন্মেষ হইয়াছিল যে, উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমান দুইটি সম্প্রদায় দুইটি পৃথক দাবি। এই সময়টিতেই একদিকে গোঁড়া হিন্দু মহাসভীদের আর অন্যদিকে উগ্রপন্থী কংগ্রেসীদের হাতে মুসলমানদের বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা হইয়াছিল। তাই এই সময়েই কায়েদে আজম মুসলিম লীগের স্থায়ী সভাপতির পদ গ্রহণ করিতে সক্ষম হন। অত্যুক্তি হইবে না যদি বলা হয় যে লক্ষেèৗ চুক্তির ব্যর্থতা এবং খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসমূহই পাক-ভারতের কোটি কোটি মুসলমানকে ১৯৪৭ সালে মুক্তির পথে নেতৃত্ব দানে জাতির পিতা কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ প্রয়োজনীয় মনোবল ও প্রেরণা যোগাইয়াছিল।” তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘‘স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ক্রমশ দানা বাঁধিতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে যশোরের আবুল হুসাইন অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মৌলানা আকরম খাঁ, কবি গোলাম মোস্তাফা ও কাজী আবদুল ওয়াদুদ প্রমুখ চিন্তাবিদের লেখনী ও আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠ নিঃসৃত কওমি সঙ্গীত মুসলমানদের স্বাজাত্যবোধ ও আত্মচেতনার খোরাক যোগাইতে থাকে।’’ [মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম। পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি। ১ম খ-, ঢাকা, ১৯৬৯]। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় যা বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল, ছাত্ররা দেশ ও কৃষ্টি পাঠ্য তালিকা থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। বাঙালী জাতীয়বাদী আন্দোলন হালে পানি পেত না যদি আমাদের জেনারেশন সম্পূর্ণভাবে এই ধরনের পাঠ্যপুস্তক বা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরাভূত হতাম। এ না হওয়ার প্রধান কারণ, সাংস্কৃতিক জাগরণ। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই তরুণ সাহিত্যিক শিল্পীরা পাকিস্তান প্রত্যয়ের বিপরীতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করতে চাইলেন যার সঙ্গে যুক্ত ছিল ত্রিশ দশকের প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন এ ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করল পাকিস্তান প্রত্যয়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। গানে, কবিতায়, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, নৃত্যÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ১৯৭০ পর্যন্ত আমরা এই স্ফূরণ দেখি। রবীন্দ্রনাথের পক্ষের আন্দোলন এ কারণেই হয়েছিল। স্কুল-কলেজে আমাদের বাংলা পাঠ্যবইয়ে আমাদের পড়তে হয়েছে বাঙালীদের বাঙালীর জন্য লেখা। কৃষ্ণচন্দ্রের, কালীপ্রসন্ন ঘোষের রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছিল পাঠ্য। আমরা মুখস্থ করেছিÑ ‘আমাদের দেশে সে ছেলে হবে কবে’, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে’, ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ বা ‘দুই বিঘা জমি’, বা নজরুলের উদ্দীপনা জাগানিয়া কবিতা। পড়তে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের গল্প। স্কুল লাইব্রেরিতে থেকে চিরায়ত সাহিত্য পড়তে আমাদের বাধ্য করা হতো। এভাবেও কিন্তু বাঙালী মননের চর্চা আমরা করেছিলাম। জমিটা তৈরি হয়েছিল যে কারণে বাঙালী জাতীয়তাবাদ চারাগাছ থেকে মহীরুহ হতে পেরেছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চায় এক ধরনের বাধ্যবাধকতা ছিল। ছোট একটি উদাহরণ দিই। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন প্রতিটি বিভাগের নবীনবরণ উৎসব হতো জাঁকজমকের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে। একমাত্র আমরা তাতেই মগ্ন থাকতাম। পাড়ায় পাড়ায় ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মনোজগতে যা পাকিস্তানবাদ থিতু হয়ে বসতে দেয়নি। পাকিস্তানবাদ আমরা একেবারে পরিত্যাগ করতে পেরেছিলাম তা নয়, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ১৯৭১ সালে আমাদের প্রস্তুত করে তুলেছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলা সম্পর্কিত প্রচলিত কিছু ধারণা প্রচার করা হয়েছে যার অন্যতম ‘সোনার বাংলা’। এটি ব্যবহৃত হয়েছিল পাকিস্তানী ধারণা/ইতিহাসের বিপরীতে। সোনার বাংলা ছিল অতীতে যেখানে মানুষে মানুষে [হিন্দু-মুসলমান] ভেদাভেদ ছিল না, গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ [বাঙালীর বর্তমান দারিদ্র্য-এর পরিপ্রেক্ষিতে] ছিল আর ছিল অপার শান্তি। সে যুগে ফিরে যাওয়া যায় যদি পাকিস্তানের কবল থেকে বেরিয়ে আসা যায়। (চলবে)
×