ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খালেদা শূন্য হাতে ফেরায় মুষড়ে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৭ এপ্রিল ২০১৫

খালেদা শূন্য হাতে ফেরায় মুষড়ে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ খালেদার ৯২ দিন পর একরকম শূন্য হাতে ঘরে ফেরার ঘটনায় আত্মসমালোচনার ঝড় বইছে বিএনপিতে। প্রায় তিন মাস ধরে অবরোধ-হরতাল চালিয়েও হঠাৎ করে বিএনপি নেত্রীর কার্যত ‘রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ’-এর ঘটনায় ফের অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয়েছে দলটিকে। দু-দু’বার রাজনৈতিক পরাজয় ও আন্দোলনে ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়েছে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে স্বস্তি ও প্রশান্তির হাওয়া বইছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শিবিরে। উজ্জীবিত দলটির নেতারা এটা নেত্রী শেখ হাসিনার তাদের সাহসী রাজনৈতিক কৌশলী লড়াইয়ের ‘দ্বিতীয় বিজয়’ হিসেবেই দেখছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরে চলা রাজনৈতিক এই জয়-পরাজয়ের আলোচনাই সোমবার পরিণত হয়েছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে। কোন দাবি আদায় ছাড়াই রণেভঙ্গ দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘরে ফিরলেও রেখে গেছেন বেশ কিছু প্রশ্ন। মাঠে-ঘাটে, শহরে-বন্দরে, চায়ের দোকানে সব শ্রেণী পেশার মানুষের এখন একই প্রশ্ন- এতো মানুষের জীবনহানি ঘটিয়ে কী অর্জন হলো বিএনপি-জামায়াত জোটের? এতো ক্ষয়-ক্ষতিরই বা কী জবাব দেবেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া? পেট্রোলবোমা মেরে মানুষকে দগ্ধ করে পৈশাচিক কায়দায় হত্যার সংস্কৃতি আমদানি করে স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চাকে ধ্বংসের প্রচেষ্টার দায় এখন কে নেবে? দেশের সর্বত্র সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে এই একই প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে। রাজনৈতিক মহলেও এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সেই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে- বিএনপির আন্দোলনের দ্বিতীয় দফার এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে সরকারে ফিরে এসেছে স্বস্তি; যা বিএনপির তৃণমূলের নেতারাও সরকারের ‘বিজয়’ বলে মানতে বাধ্য হয়েছে। দলটির মাঠের নেতারাও স্বীকার করছেন, দমন-পীড়ন কিংবা রাজনৈতিক কৌশল যে করেই হোক, শেষ পর্যন্ত সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে। বিএনপিকে কার্যত আত্মসমর্পণে বাধ্য করাতে পেরেছে। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব যে ব্যর্থ, তাও জনগণের সামনে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে সরকারপক্ষ। এখন বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে। প্রায় ৯২ দিন ধরে বাড়ি ছেড়ে গুলশানের কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থেকে টানা ৯০ দিন অবরোধ, সপ্তাহে ৫ দিন করে হরতালসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছেন। দাবি ছিল সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের। এই দাবি আদায় করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট আমদানি করেছিল পেট্রোলবোমা হামলা ও মানুষ পুড়িয়ে। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে ঝরে গেছে দেড়শ’ নিরীহ মানুষের জীবন, জীবন্ত দগ্ধ হয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন সারাদেশের প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। দেশের সম্পদহানি হয়েছে নজিরবিহীন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। সর্বস্বান্ত হয়েছে শত শত পরিবার। এই তিন মাস দেশবাসীর কেটেছে দুঃসহ যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর আর্তনাদ আর অসহনীয় ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে। বিশ্ব ইজতেমা, ঈদে মিলাদুন্নবী, এসএসসি পরীক্ষা, এমনকি নিজের পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর লাশ ঢাকায় আনার পরও হরতাল-অবরোধ থেকে পিছু হঠেননি খালেদা জিয়া। ‘কিছু একটা হবে’ এই আশায় তিনি দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী। বাস্তবে রাজপথে রক্তের হোলি খেলে ও দেশের এতো ক্ষয়ক্ষতি করেও একটি দাবি আদায় করতে পারেননি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট। প্রায় দেড়শ’ মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, দেশের সীমাহীন সম্পদহানির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার খড়গ দলটির নেতাকর্মীদের নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিএনপিকে দ্বিতীয়বারের মতো রাজনৈতিক কৌশলী খেলায় পরাজিত করার ঘটনায় শাসক দল আওয়ামী লীগের শিবিরে স্বস্তির সুবাতাস বইলেও দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এটি তাদের প্রাথমিক বিজয়। চূড়ান্ত বিজয় এখনও অর্জিত হয়নি। তাই এখন আওয়ামী লীগকে আরও সাবধানে পথ চলতে হবে। আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করে বিএনপিকে আরও অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দেয়াই এখন দলটির একমাত্র টার্গেট। বিএনপি সহিংসতার পথ পরিহার করলেও দেড়শ’ মানুষ হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো আরও সচল এবং হত্যাকারী-নাশকতাকারীদের সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পথেই হাঁটছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আন্দোলনের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে পরাজিত সৈনিকের মতো বাসায় ফিরেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এটা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের সাহসী লড়াইয়ের প্রথম বিজয়। দেশের মানুষ তার সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গীবাদী আন্দোলনে ন্যূনতম সমর্থন করেনি বলেই বিএনপি নেত্রী মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরেছেন। তবে আমাদের আত্মতুষ্ঠিতে ভুগলে চলবে না। আমাদের আরও সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থেকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আগামীর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনকিছু দাবি আদায় ছাড়াই শূন্য হাতে ঘরে ফেরার ঘটনায় বিএনপিতে আত্মসমালোচনার ঝড় বইছে। কেন এমন আত্মসমর্পণ ও রাজনৈতিক পরাজয়? এতো মানুষ হত্যা করে আন্দোলনে কী প্রাপ্তি ঘটলো? আর বার বার আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয়ের জন্য দলের কারা দায়ী- এসব নিয়ে বিএনপিতে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রশ্ন উঠেছে- রণেভঙ্গই যদি দেয়া হবে তবে প্রায় দেড় শ’ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হলো কেন? কেন-ই বা বিএনপিকে সারা বিশ্ববাসীর সামনে সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী দল হিসেবে পরিচিত করা হলো? আন্দোলন করতে গিয়ে দলের বেশকিছু নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে, শত শত নেতাকর্মী নাশকতার মামলায় কারাগারে বন্দী রয়েছে। কেন নেতাকর্মীদের জীবনকে এমন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়া হলো? এসবের দায়-দায়িত্ব কে নেবে? এসব কথা এখন বিএনপি সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কন্ঠে বারবার উঠছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগরের একাধিক বিএনপি নেতা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, অতিরিক্ত জামায়াত নির্ভরতা আর লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের অপরিপক্ব সিদ্ধান্তই আবারও ডুবাল বিএনপিকে। জামায়াত যে জঙ্গীবাদী-সন্ত্রাসী সংগঠন তা শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বেই প্রমাণিত। এই জামায়াতই পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ মারার কৌশল আমদানি করে বিএনপিকেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জনগণের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তাঁদের মতে, খালেদা জিয়া তারেক রহমান কিংবা জামায়াতের কথা না শুনে দলের পোড়খাওয়া নেতাকর্মীদের কথা শুনতেন তবে তাঁকে দ্বিতীয়বারের মতো এমন রাজনৈতিক পরাজয়ের কবলে পড়তে হত না। তিন মাস ধরে দেশের মানুষ আন্দোলনের নামে যে ভয়াল নাশকতা, সহিংসতা ও পৈশাচিক কায়দায় পুড়িয়ে মানুষ হত্যার দৃশ্য দেখেছে, তাতে আগামীতে জনগণের সামনে যাওয়াই কষ্টকর হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের সহিংস আন্দোলনে গিয়ে চার ধরনের পরাজয় ঘটেছে বিএনপি-জামায়াত জোটের। তিন মাস গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানের পর একথায় শূন্য হাতে বিএনপি নেত্রীর বাসায় ফিরে যাওয়ার ঘটনায় তাদের কথিত আন্দোলন যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে তা প্রমাণিত হয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ, জামিন নিয়ে ঘরে ফেরা এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার পূর্বাপর দাবি এবং অভিযোগগুলোই অসাড় ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম থেকেই বর্তমান সরকারকে তিনি ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসলেও সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতাই দিলেন খালেদা জিয়া। তাঁদের মতে, হঠাৎ করেই আত্মসমর্পণের ঘটনায় আগামী ২০১৯ সালের আগে বিএনপি আর কার্যকর আন্দোলন কিংবা নির্বাচন দাবি তুলে তার পক্ষে জনগণের সমর্থন আদায় করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক সুস্থধারার আন্দোলনের পরিবর্তে জঙ্গী-তালেবানী কায়দায় সন্ত্রাসনির্ভর আন্দোলনে গিয়েও বিএনপি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যা ভবিষ্যত সরকারবিরোধী আন্দোলনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ নিয়ে দু-দুবার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে দলটির সর্ব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। আগামীতে বিএনপি নেত্রীর ডাকে আর তেমন নেতাকর্মী রাজপথে কোন ঝুঁকিও নেবে কি না, এ নিয়েও যথেষ্ট সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। বরং দু’দফা রাজনৈতিক পরাজয়ের ঘটনায় আগামীতে বিএনপির সামগ্রিক রাজনীতিকেই অস্তিত্বের মুখে ঠেলে দিতে পারে। রাজনৈতিক পরাজয়ে হতাশায় নিমজ্জিত বিএনপি নেতারা এখন ‘সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার কথা বলে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টায় নেমেছে। সরকার ও বিএনপির মধ্যে গোপন সমঝোতা হয়েছে এমন গুঞ্জনও পরিকল্পিতভাবে ছড়ানোর চেষ্টা চলছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের গোপন সমঝোতার ঘটনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের মতে, এটা স্রেফ গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার কেন আন্দোলনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করতে যাবে। সরকার শক্তহাতে ও রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সকল নাশকতা-সহিংসতা ও মানুষ হত্যার রাজনীতি ব্যর্থ করে দিয়ে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সফলতা দেখিয়েছে। আসলে আন্দোলনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে দেশের জনগণের কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করা বিএনপির নেতারা এমন গুজব ছড়িয়ে দেশবাসীর রোষানল থেকে নিজেদের বাঁচানোর কৌশল নিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, সমগ্র দৃশ্যপট দেখলে মনে হয় ‘কিছু একটা’ হয়েছে। সবাই বিশ্বাস করে যে, আড়ালে এক ধরনের সমঝোতা হতে পারে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদসহ দলটির একাধিক নেতা সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সমঝোতার খবরকে স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, তাদের কাছে কোন ধরনের সমঝোতার খবর নেই। এ ধরনের তথ্যের কোন সত্যতাও নেই। বিএনপি তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। নাশকতা করে মানুষ পুড়িয়ে জনসমর্থন শূন্যের কোটায় চলে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেই বিএনপি পিছু হঠেছে।
×