ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আত্মসমর্পণ করে জামিন নিলেন ॥ শুনানি ৫ মে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৬ এপ্রিল ২০১৫

আত্মসমর্পণ করে জামিন নিলেন ॥ শুনানি ৫ মে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা দুই দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। রবিবার তিন মাস পর তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান তিনি। পরে ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাঁর এই জামিন মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে আসামিপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে রবিবারের সাক্ষ্যগ্রহণও পিছিয়ে দিয়ে আগামী ৫ মে শুনানির নতুন দিন নির্ধারণ করেন বিচারক। ওই দিন সাক্ষীদের হাজির করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে আদেশে। এর আগে টানা কয়েকটি ধার্য তারিখে হাজির না হওয়ায় এই বিচারকই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছিলেন। পরে গত ৪ মার্চ পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন করলেও আদালত তা খারিজ করে দেন। এদিকে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে তার গুলশান কার্যালয় থেকে বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা পর্যন্ত রাস্তায় কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালত এলাকা ঢেকে দেয়া হয় নিরাপত্তার চাদরে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার আদালতে হাজির হওয়াকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রেসক্লাব, ঢাকা মেডিক্যাল, বকশিবাজারসহ রাস্তার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়ার সময় তারা সেøাগান দিতে থাকে। জামিন আবেদনে খালেদার আইনজীবীরা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারর্সন নিরাপত্তার কারণে এতদিন আদালতে আসতে পারেননি। ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ বলেই এখন তিনি হাজির হয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষে এই জামিন আবেদনের বিরোধিতা করা হয়নি। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, জামিন নিয়ে তাদের কখনোই ‘বিরোধিতা ছিল না’। তারা গ্রেফতারী পরোয়ানা চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া হাজির না হয়ে ‘বিচার এড়াচ্ছিলেন’ বলে। জামিন আদেশের আগে বিচারক বলেন, ‘আমিও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি তো গ্রেফতারী পরোয়ানা দিতাম না। কিন্তু বাধ্য হয়েছি। কারণ গ্রেফতারী পরোয়ানা না দিলে এই মামলার বিচার যে এগোনো সম্ভব নয়; রাষ্ট্রপক্ষের এমন দাবির সঙ্গে আমিও একমত।’ এদিকে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদকেও জামিন দেন বিচারক। এছাড়া এ মামলার অপর আসামি খালেদার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দিতে পারবেন বলেও আদেশে জানানো হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ দুই মামলার আসামিদের বিচার শুরু হয়। কিন্তু দফায় দফায় আসামিপক্ষের সময়ের আবেদন গত এক বছরে কেবল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার বাদী হারুন অর রশীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলার আগামী ধার্য দিনে আসামিপক্ষ বাদীকে জেরা করবেন বলে দুদকের আইনজীবী জানান। সোয়া পাঁচ কোটি টাকা দুর্নীতির এই দুই মামলার বিচার কাজ চলছে বকশিবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ এজলাসে। আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ॥ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাজিরাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অস্থায়ী আদালতের চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল রবিবার। আদালত ভবনের আশপাশ ও সামনের মাঠে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছিল। আশপাশের সড়কে ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের উপস্থিতি। রবিবার ভোর থেকেই ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখা যায়। সাঁজোয়া যান (এপিসি), জলকামান নিয়ে আদালতের সামনে অবস্থান নেয় পুলিশ। পাশাপাশি র‌্যাবের টহল যানও দেখা গেছে। সকাল ১০টার দিকে বকশিবাজার মোড় থেকে আলিয়া মাদ্রাসা দিকের সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। আদালতে ঢোকার প্রধান ফটকেও পুলিশের কড়াকড়ি ছিল । আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের তালিকাভুক্ত আইনজীবী ও মিডিয়াকর্মী ছাড়া অন্যদের সেখানে আটকে দেয়া হয়। আদালত চত্বরের সামনের সড়কে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও বিজিবির কয়েকটি গাড়ি অবস্থান নিয়েছিল। এ বিষয়ে চকবাজার থানার পরিদর্শক (পেট্রোল) সাইফুল ইসলাম বলেন, খালেদা জিয়ার হাজিরা ঘিরে আদালত চত্বর ও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে আইশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। যেভাবে তিনি এলেন ॥ আদালতে হাজির হতে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে গুলশানের কার্যালয় ছাড়েন খালেদা জিয়া, যেখানে গত ৩ জানুয়ারি থেকে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। আদালতের আসার সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও ছিলেন খালেদা জিয়ার গাড়িতে। গাড়িবহরে অন্য তিনটি পিকআপ ও চারটি মাইক্রোবাস ছিল। সঙ্গে ছিল পুলিশের একটি গাড়ি। গাড়ি বহর ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে বকশিবাজারে অবস্থিত অস্থায়ী আদালতে পৌঁছায়। এজলাসে খালেদা জিয়ার বসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। পরে জামিন নিয়ে বেলা পৌনে ১২টার দিকে আদালত থেকে বের হয়ে খালেদা জিয়া সরাসরি তার গুলশানের বাসায় যান। গত ৯১ দিন ফিরোজা নামের ওই বাড়িতে তার পা পড়েনি। জামিন আবেদনের শুনানি ॥ খালেদার পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মাহবুবউদ্দিন খোকন ও সানাউল্লাহ মিয়াসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। গত ২৪ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া আদালতে আসার পথে ‘তার গাড়িবহরে হামলা হয়েছিল’ অভিযোগ করে আইনজীবীরা বলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ বিএনপি চেয়ারপারসন আদালতে হাজির হতে পারেননি। এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়া ‘হাজির হতে চাইলেও’ আইনজীবীরাই তাঁকে ‘আসতে দেননি’। খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর বিষয়টিও তাঁরা আদালতে না আসার কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। এ সময় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কারণেই এ মামলার ‘এই অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘জামিনে আমাদের বিরোধিতা ছিল না। ওয়ারেন্ট চেয়েছি উনি আসেননি বলে। সাক্ষ্যগ্রহণ এড়াতে চাইছিলেন বলে।’ খালেদা জিয়ার ‘বয়স, মর্যাদা, তাঁর ছেলের মৃত্যু ও অন্যান্য বিষয়’ আমলে নিয়ে এবং তিনি যদি ‘নিয়মিত আদালতে আসেন, বিচারের বাধা সৃষ্টি না করার প্রতিশ্রুতি দেন’, তাহলে আদালত জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন বলে মত দেন দুদকের আইনজীবী। জামিনের পাশাপাশি সাক্ষ্যগ্রহণ পিছিয়ে দিয়ে মামলার বাদীকে জেরা করার জন্য জব্দ তালিকাসহ নথিপত্রের সত্যায়িত অনুলিপির আবেদন করেন খালেদার আইনজীবীরা। এর বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে বলা হয়, মামলার এই পর্যায়ে এসে কাগজপত্র দিতে গেলে সাক্ষ্যগ্রহণ আরও পিছিয়ে যাবে। দুই পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আসামিপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে সাক্ষ্য মুলতবি করেন। তিনি প্রথমে ২৬ এপ্রিল শুনানির পরবর্তী তারিখ রাখলেও খালেদার আইনজীবীরা সিটি নির্বাচনের কথা বলে আরও সময় চাইলে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৫ মে দিন ঠিক করে দেন বিচারক। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বাকি ছয় সাক্ষী সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হারুনুর রশিদ, অফিসার (ক্যাশ) শফিউদ্দিন মিয়া, আবুল খায়ের, প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সিনিয়র এ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা নাজমা পারভীন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আফজাল হোসেন এদিন আদালতে হাজির ছিলেন। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ॥ ২০১১ সালের ৮ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন-খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু হতেই পলাতক। তাঁর বিরুদ্ধে গেফতারী পরোয়ানাও রয়েছে। খালেদাসহ বাকি দুই আসামি জামিনে রয়েছেন। অরফানেজ ট্রাস্ট ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি দায়ের করে। এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন উর রশিদ ২০১০ সালের ৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। তারেক রহমান উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। রবিবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদও জামিন পান। বাকি দুজন পলাতক।
×