ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এইচএসসি পরীক্ষায় কেন্দ্র পরিদর্শনে মন্ত্রীর বিশাল বহর

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩ এপ্রিল ২০১৫

এইচএসসি পরীক্ষায় কেন্দ্র পরিদর্শনে মন্ত্রীর বিশাল বহর

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশের পাবলিক ও ভর্তি পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কেন্দ্র পরিদর্শন দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। তবে বুধবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রে শিক্ষামন্ত্রী, কর্মকর্তা, সাংবাদিকদের বিশাল বহরের প্রবেশ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রশ্ন উঠেছে পরীক্ষার সময় এভাবে গণমাধ্যমসহ দলবল সহকারে কেন্দ্র পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হচ্ছে সমালোচনা। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেহেতু একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাই কেন্দ্র গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রী অভয় দিতে পারেন। কিন্তু কোনভাবেই বুধবারের মতো বিশাল বহর নিয়ে কেন্দ্র পরিদর্শন করা উচিত নয়। কারণ এতে পরীক্ষার্র্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও সঠিক দায়িত্ব পালন করা বাঞ্ছনীয়। জানা গেছে, ঘটা করে মন্ত্রীদের পরিদর্শন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার পর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল প্রক্রিয়াটি। সমালোচনার কারণে একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী নিজেরাই ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষার্থীদের কক্ষে প্রবেশ বন্ধ রেখেছিলেন। কেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বাইরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফ করেছেন মন্ত্রী। কেন্দ্রের বাইরে উদ্বিঘœ অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কিন্তু বুধবার শিক্ষামন্ত্রী আবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের একটি পরীক্ষাকক্ষে যান দলবল নিয়েই। বাধা না দেয়ায় মিডিয়াকর্মী বিশেষত টেলিভিশন ক্যামেরাপার্সনরা রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অথচ পরিদর্শনে যাওয়ার পরই কর্মকর্তা ও মিডিয়ার কাছে মন্ত্রীর আবেদন ছিল, ‘কেউ ভেতরে প্রবেশ করবেন না। আমি বাইরে এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।’ একাধিক প্রতিবেদক বিষয়টিতে সায়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হলো তা এক কথায় ‘কেন্দ্রে বিশাল বহরের প্রবেশ’। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ১৯টি টেলিভিশন ক্যামেরা, ১১ জন আলোকচিত্রী, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আরও কয়েকজন প্রতিবেদক এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিশাল এক দল প্রথম দিন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর পাঁচ মিনিট পর ভিকারুননিসার ২১২ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন মন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষাকক্ষে ঢোকার আগেই হুড়োহুড়ি করে সেখানে অবস্থান নেন বিভিন্ন টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন ও আলোকচিত্রীরা। যেহেতু কোন বাধা নেই তাই, ৮-১০ জন প্রতিবেদকও বিনা বাধায় পরীক্ষাকক্ষে ঢোকেন। প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থী ওই কক্ষে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। মন্ত্রীর দলবল ও সংবাদকর্মীদের মিলিয়ে অন্তত ৪০ জন যোগ হওয়ায় পরীক্ষাকক্ষে হঠাৎ অব্যবস্থাপনা, হুড়োহুড়ি। কয়েকটি টেলিভিশনের সাংবাদিককে পরীক্ষাকক্ষেই তার ক্যামেরাপার্সনকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। উত্তর লিখতে ব্যস্ত এক পরীক্ষার্থীকে একজন আলোকচিত্রী ক্যামেরার দিকে তাকাতে অনুরোধ করেন কয়েকবার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ডের কর্মকর্তারাও কম যান না। পরীক্ষার্থীদের রীতিমতো ঘাড়ের ওপর ক্যামেরা তাক করে শিক্ষামন্ত্রীর কেন্দ্র পরিদর্শনের ছবি নিচ্ছেন টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা। মন্ত্রী পরীক্ষাকক্ষে ঘুরে ঘুরে ৭-৮ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। পরীক্ষাকক্ষের পরিদর্শকরাও মন্ত্রীর সঙ্গে ঘুরতে থাকেন। আর টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সনরা বার বার স্থান বদল করে সেই চিত্র ধারণ করেন। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে মনোযোগ দিতে না পারায় কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে লেখা বন্ধ রেখে মন্ত্রীর দিকে তাকাতেও দেখা যায়। ৪০ জন বাড়তি মানুষের এই হুড়োহুড়ি, কোলাহল চলে বেশকিছু সময়। অরাজক অবস্থার বিষয়টি বুঝতে পেরে একপর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্রুত শিক্ষামন্ত্রীকে বাইরে চলে আসার পরামর্শ দেন। আরেকটি কক্ষে যাওয়ার কথা থাকলেও পরে আর সেখানে যাননি মন্ত্রী। পুরো বিষয়টি নিয়ে এখন বিব্রত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। একই সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীরাও অনেকে নিজেদের সহকর্মীদের দায়িত্ব বোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ক্ষেত্রে ক্যামেরাপার্সনদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গণামাধ্যমকর্মীরাই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ই বা কেন এভাবে ঘটা করে কেন্দ্র পরিদর্শন করতে যাচ্ছে? কেনই বা সাংবাদিকদের নিয়ে কেন্দ্রে যেতে হবে? এসব প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। জানা গেছে, দলবল নিয়ে কেন্দ্রে গেলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় একথা আগে বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদই। এ বিষয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে সংশ্লিষ্টদের সতর্কও করেন তিনি সবসময়। এমনকি এক বছর আগে প্রায় একই ধরনের ঘটনায় তিনি নিজেও পরীক্ষাকক্ষে প্রবেশ বন্ধ করেছিলেন। কেন্দ্রে গেলেও কক্ষে প্রবেশ করেননি। শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন কেন্দ্রের বাইরে এসে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা চিন্তা করে গেল বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় কেন্দ্রে প্রবেশ করেননি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারও। পরিদর্শনে গেলেও হলে ঢুকেননি মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। সাংবাদিকদেরও হলের ভেতরে না যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে হল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী। কেবল এ দুই মন্ত্রীই নয়। পরীক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা মাথায় রেখে ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গত বছর ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা পরিদর্শনে গেলেও কেন্দ্রে প্রবেশ করেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, এক মিনিটের জন্যও আমি পরীক্ষা হলে প্রবেশ করলে পরীক্ষার্থীদের ডিস্টার্ব হবে। আমার সঙ্গে সাংবাদিকরাও প্রবেশ করবেন। হলে পরীক্ষার্থীদের প্রতিটি সেকেন্ড অনেক মূল্যবান। এজন্য আমি হলে প্রবেশ করিনি। কিন্তু যে শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি নজরে আনেন সবার আগে, যে নিজেও সমালোচনার কারণে সতর্ক হয়েছিলেন বুধবার তার পরিদর্শন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ায় বিব্রত অনেকেই। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষক বলছিলেন, বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় আমরাও বিব্রত। ওই শিক্ষক অবশ্য বলছিলেন, আসলে মন্ত্রীর পরিদর্শনকালে বৃষ্টি হওয়ায় একটু এলোমেলা হয়ে গিয়েছিল। তবু সাংবাদিকদের কাছে আমরা অনুরোধও করেছিলাম। মন্ত্রীমহোদয় সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের বাইরে অপেক্ষর জন্য বলেছিলেন। কিন্তু অনেক লোকজন হওয়ায় ব্যবস্থাপনায় এমনটি হয়েছে। অভিভাবকদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশ অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপা সুলতানা বলছিলেন, দেখেন এমনতেই আমাদের সন্তানরা একটা আতঙ্কের মধ্যে পরীক্ষা দিচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রী হয়ত ভেবেছেন তিনি কেন্দ্রে গেলে শিক্ষার্থী অভিভাবকরা একটু সহস পায়। কিন্তু বুধবারের মতো হলো তো বিপদ। এতে পরীক্ষার্থীদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি দেখবেন। আমাদের সাংবাদিক ভাইদেরও একটু বিষয়টি খেয়াল করা বাঞ্ছনীয়। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক রাশেদা আক্তার বলছিলেন, আমরা টিভিতে দেখি মন্ত্রীরা পরীক্ষার সময় হলের ভেতরে বাচ্চাদের সঙ্গে কথাও বলেন। সাংবাদিকরা হলের ভেতরে গিয়ে ছবি করেন। এমন করলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি সময়ও নষ্ট হয়। সেই সময় তো বাচ্চাদের দেয়া হয় না। মন্ত্রীদের যদি হলের ভেতরের পরিস্থিতি দেখতেই হয় তবে তাদের একাই যাওয়া উচিত। এত মানুষ, ক্যামেরা নিয়ে কেন? এই অভিভাবকদের ক্ষোভ আছে সাংবাদিক বিশেষত ক্যামেরাম্যানদের ওপর। বলছিলেন, গত জেএসসি পরীক্ষার হলে ঘোষণা দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেননি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আমরা এক বাচ্চার পরীক্ষ ছিল যেখানে সেই স্কুলে গিয়েছিলেন মন্ত্রী। কক্ষের ভেতরে যাননি। তবে কথা রাখেননি ফটো সাংবাদিকদের কেউ কেউ। মন্ত্রীর চলে যাওয়ার পর বেশকিছু বেসরকারী টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ক্যামেরাম্যানকে ছবির জন্য কক্ষে প্রবেশ করেন। তারা কারও কথাও শুনতে চাননি। তাদের নাকি লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) করতে হবে। এই লাইভের প্রতিযোগিতা কি বন্ধ হবে না? জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামূল কবীর বলছিলেন, যে সংকটের মধ্যে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা তাতে মাননীয় মন্ত্রী হয়তো ভেবেছেন তিনি কেন্দ্রে গেলে শিক্ষার্থী অভিভাবকরা একটু সহস পান। তবে মন্ত্রীর সঙ্গে এভাবে অনেক লোকজন যাওয়া ঠিক নয়। সকলেরই বিষয়টি খেয়াল করা উচিত। পুরো বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। রক্তিম তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘ঐ পরীক্ষার হলের পরীক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হল এর দায়ভার কে নিবে? মন্ত্রী, মিডিয়া কেউ-ই খেয়াল করলেন না ক্ষতির বিষয়টি। আববর লিখেছেন, ‘সাংবাদিকদের তো উনি ইনভাইট করেন নাই। আর সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার না দিলে তো উনারা হাঙ্গামা করত। ১৯টা ক্যামেরা তো আর উনি যোগাড় করেননি।
×