ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াশিকুরের দুই খুনীর ৮ দিনের রিমান্ড, দাফন গ্রামের বাড়িতে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১ এপ্রিল ২০১৫

ওয়াশিকুরের দুই খুনীর ৮ দিনের রিমান্ড, দাফন গ্রামের বাড়িতে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ব্লগার ও লেখক ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে খুন করার সময়ে হাতেনাতে আটক জঙ্গী সংগঠনের সদস্য দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। সোমবার রাতে ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ বাদী হয়ে জিকরুল্লাহ, আরিফুল, তাহের ও মাসুমÑ এই ৪ জনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রেফতারকৃত খুনীরা। নিহত ওয়াশিকুরের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে লাশ নেয়া হলে শোকের মাতম সৃষ্টি হয়। হৃদয় বিদারক করুন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে দাফন করার মধ্য দিয়ে চির বিদায় দেয়া হয়েছে ওয়াশিকুরকে। জঙ্গী সংগঠনের সদস্য দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। তাদের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মহানগর হাকিম ইউনূস খান। দুই আসামির পক্ষে আদালতে কোন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না এবং তাদের পক্ষে জামিনের আবেদন জানানো হয়নি। তারাই আদালতের অনুমতি নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলেন। মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে শুনানিতে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আলতাফ হোসেন বলেন, দুই আসামি (জিকরুল্লাহ ও আরিফ) ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যায় সরাসরি জড়িত। তারা লেখক অভিজিত রায় হত্যার সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আদালত পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আনিসুর রহমান বলেছেন, আসামিরা বলেছে, মাসুম নামে একজনের নির্দেশে তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে। আবু তাহের নামে আরেকজন তাদের সঙ্গে ছিল। মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে সোমবার সকালে ওয়াশিকুর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়ির বাসা থেকে বের হলে, তার বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-ের পর পরই জনতা ধাওয়া করে জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে ধরে ফেলে। এ সময় তাদের আরেক সঙ্গী তাহের পালিয়ে যায়। চারজনকে আসামি করে মামলা ॥ সোমবার রাতে ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামি করা হয়েছে খুনের সময়ে হাতেনাতে ধরে ফেলা জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা জানায় তাদের সঙ্গে থাকা আরেক সহযোগী তাহের পালিয়ে যায়। তাকেও আসামি করা হয়েছে। আটক দুইজন জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ওয়াশিকুর খুনের সার্বিক পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানকারী ছিলেন মাসুম নামে একজন। আসামি করা হয়েছে মাসুমকেও। তবে খুনের ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পালিয়ে যাওয়া খুনী ও খুনের পরিকল্পনাকারীকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। জিকরুল্লাহ জেএমবির সদস্য হিসেবে ধরা পড়েছিল ॥ ওয়াশিকুর রহমান খুনের ঘটনায় হাতেনাতে আটক জিকরুল্লাহ এর আগে জেএমবির সদস্য হিসেবে ধরা পড়েছিল নরসিংদীতে। তারপর জামিনে ছাড়া পেয়ে এবার খুন করেছে ওয়াশিকুর রহমানকে। এই খুনের ঘটনায় আরও কয়েকজন জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। খুনের সঙ্গে সরাসরি ৩ জন জড়িত হলেও আশপাশে আরও কয়েকজন ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। খুন করার জন্য খুনীদের প্রটেকশন দেয়ার জন্য আশপাশে ছিল সহযোগীরা। হাতেনাতে আটক জিকরুল্লাহ ও আরিফকে রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিজিত হত্যায় জড়িত বলে সন্দেহ ॥ তেজগাঁও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা দুইজনকে আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন, হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী মাসুমই তিনজনকে দক্ষিণ বেগুনবাড়ির ওই স্থান দেখিয়ে ওয়াশিকুরকে হত্যার কথা বলেন। গ্রেফতারকৃত দুইজন একে আপরকে আগে চিনতেন না। আগে কখনও তাদের দেখাও হয়নি- বলে পুলিশের কাছে দেয়া তথ্যগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখছে পুলিশ কর্মকর্তারা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একই কায়দায় খুন হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়। ওয়াশিকুর হত্যায় জড়িত আসামিরা ওই ঘটনায় জড়িত ছিল কি না- তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি এ্যাকাউন্ট থাকলেও ওয়াশিকুর মূলত লেখালেখি করতেন ফেসবুকের কয়েকটি এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। বিভিন্ন নামে একাধিক ব্লগে লিখতেন ॥ বিভিন্ন নামে একাধিক ব্লগ সাইটে এবং তার ফেসবুক প্রোফাইলে সমকালীন নানা বিষয়ে মতামত লিখতেন নিহত ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ফেসবুক ও অন্যান্য কিছু বাংলা ব্লগ সাইটে দেখা গেছে, ওয়াশিকুর রহমানের লেখালেখির অন্যতম বিষয় ছিল ইসলাম-সহ নানা ধর্মের সমালোচনামূলক প্রসঙ্গ। তার বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকের মধ্যে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হতো। ফেসবুকে তার প্রোফাইলে নাম ছিল ওয়াশিকুর বাবু। এছাড়াও কয়েকটি ব্লগ সাইডে তিনি ‘কুচ্ছিত হাঁসের ছানা’, ‘গ-মূর্খ’, ‘বোকা মানব’ ইত্যাদি একাধিক নামে লিখতেন ওয়াশিকুর। মুক্তচিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংসার বা গোড়ামি-ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রায়ই লেখালেখি ও তীক্ষè মন্তব্য করতেন তিনি। এর আগে যে দুজন ব্লগার ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার কারণে ধারালো অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তের আক্রমণে নিহত হন সেই রাজীব হায়দার বা থাবা বাবা এবং গত মাসে নিহত ব্লগার ও লেখক অভিজিত রায় হত্যাকা-ের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিকবার মন্তব্য করেছেন ওয়াশিকুর। তার মন্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাব আসে ফেসবুকে ব্যবহারকারী অন্যদের কাছ থেকে। আই এ্যাম অভিজিত ॥ ওয়াশিকুরের ফেসবুকে সর্বশেষ প্রোফাইল ছবিটি ছিল ‘আই এ্যাম অভিজিত’ লেখা একটি পোস্টার। ইংরেজীতে লেখা আছে, ‘শব্দের মৃত্যু নেই’। তিনি এথিস্ট (নাস্তিক) বাংলাদেশ এবং বাংলার শার্লিসহ (ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদু) কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও লজিক্যাল ফোরাম নামের একটি অনলাইন ডিসকাশন ফোরামেরও সদস্য ছিলেন তিনি। বিচার চায় তার পরিবার ॥ ওয়াশিকুরের চাচাতো ভাই হেলাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, ওয়াশিকুরের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে। ওয়াশিকুর রহমান ২০০৪ সালে রামগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর চ-িপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি, তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে ঢাকাস্থ মতিঝিল ফারইস্ট ট্রাভেলস এভিয়েশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে তেজগাঁও কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। নিহতের পিতার নাম টিপু সুলতান। ওয়াশিকুর তেজগাঁও বেগুনবাড়ি দিপীকার মোড় এলাকায় থাকতেন। ওয়াশিকুর ফারইস্ট এভিয়েশনের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওয়াশিকুর কথা কম বলতেন। সে এ ধরনের লেখালেখি করত সেটিই জানতাম না বলে জানায় পরিবারের লোকজন। পুলিশের হাতে আটক দুইজন স্বীকার করেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার জন্যই হত্যা করা হয়েছে ওয়াশিকুর রহমানকে। তার আচরণ খুব ভাল ছিল, তার সঙ্গে কখন ও কারও মতনৈক্য হয়নি। এ রকম ছেলেকে মেরে ফেলা মেনে নেয়া কষ্টকর। এ হত্যাকা-ের বিচার চেয়েছেন তার পরিবারবর্গ। গ্রামের বাড়িতে দাফন ॥ লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ৫নং চ-িপুর ইউনিয়নের উত্তর হাজীপুর গ্রামের নোয়াবাড়ির টিপু সুলতানের ছেলে ওয়াশিকুর রহমান তুষার বাবুর (২৬) মৃত্যুর খবর উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তার গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। চলছে শোকের মাতম। নিহতের বাবা টিপু সুলতান ছেলের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। একমাত্র বোন আসরাফী সুলতানা সিমু কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেছেন, ২০ বছর আগে আমরা মা হারাই, বাবা আমাদের ভাই-বোন দু’জনকে কোলেপিঠে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। ছোটবেলা থেকে ভাইয়া খুব মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। সে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না, শুনেছি ব্লগে একটু লেখালেখি করত, এজন্য জামায়াত-শিবির ও জঙ্গী সংগঠনের কেউ এ হত্যা করতে পারে। এছাড়া আমার ভাইয়ের কোন শত্রু ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের নিন্দা ॥ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান নিহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। দেশ দুটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এভাবে একজন মানুষকে হত্যা করার অর্থ হলো মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। তারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার দেশ দুটির ঢাকার দূতাবাসের দেয়া পৃথক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে বলা হয়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানের হত্যার ঘটনায় আমরা গভীর শোকাহত। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে বলা হয়, এভাবে আক্রমণ করে হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন হত্যা মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের প্রতি চরম আঘাত। ঢাকার জার্মান দূতাবাস থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, লেখক ও ব্লগার অভিজিত নিহত হওয়ার পরে এখন আরেকজন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। অভিজিত রায়ের হত্যার পরে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এমন ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তারা আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ফ্রান্স সরকার এক বিবৃতিতে নিহতের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে এ হত্যাকা-ের তদন্তের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে অনলাইনসহ সবক্ষেত্রে মত প্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধার কথা পুনর্ব্যক্ত করছে ফ্রান্স। সোমবার ওই হত্যাকা-ের পর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস থেকে নিন্দা জানানো হয়।
×