ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি

মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের জন্য হেল্পলাইন চালু, ২৪ ঘণ্টা খোলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ মার্চ ২০১৫

মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের জন্য হেল্পলাইন চালু, ২৪ ঘণ্টা খোলা

ফিরোজ মান্না ॥ মালদ্বীপ পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে বাংলাদেশী কর্মীরা পুলিশী আতঙ্কেই দিন কাটাচ্ছেন। যদিও দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এ নির্দেশ পুলিশ উল্টোভাবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কর্মীদের জন্য একটি ‘হেল্প লাইন’ চালু করেছেন। হেল্প লাইনের + ৯৬০৩৩২০৮৫৯ নম্বরে ফোন করে যে কোন কর্মী সহযোগিতা চাইতে পারবেন। এই হেল্প লাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। গত শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে হেল্প লাইন চালু করা হয়েছে। এর আগে মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশী কর্মীরা বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে সহযোগিতা চেয়েও পাননি। হঠাৎ করে হাইকমিশনের সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণায় কর্মীদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। সূত্র জানিয়েছে, মালদ্বীপে দুই বাংলাদেশী খুন ও দুইজনকে ছুরি মেরে আহত করার প্রতিবাদ করায় পুলিশ বাংলাদেশীদের ওপর এই দমন অভিযানে নামে। দেশটি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী কর্মীদের সতর্ক করে দেয়, খুনের ঘটনা নিয়ে কোন প্রতিবাদ বিক্ষোভ করলে ভিসা বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ হুমকির পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশী কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পুলিশের ভয়ে অনেক কর্মী গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশর ঘোষণা দেয়। গত শুক্রবার হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশী কর্মীরা জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এর আগেই বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশী কর্মীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। শনিবার কয়েকজন বাংলাদেশী কর্মী টেলিফোনে জানান, তাদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা হাইকমিশন থেকে জানানো হলেও কার্যত তারা এখন হামলাকারীদের চেয়ে পুলিশকেই বেশি ভয় পাচ্ছেন। কারণ পুলিশ যে কাউকেই ধরে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। যদি দেশে নাও পাঠায় তাহলে জেল হাজতে ঢুকাবে। পুলিশ এমন কৌশল হাতে নিয়েছে। গত ১০ দিন ধরে সেখানে বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর পুলিশী নিপীড়ন চলছে। মালদ্বীপে বর্তমানে বৈধ অবৈধ ৭০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী কাজ করছে। এদিকে মালদ্বীপ থেকে একাধিক কর্মী টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশী কর্মীরা পুলিশের ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। হাইকমিশন এতদিন বাংলাদেশী কর্মীদের বেলায় চরম উদাসীন থাকার পর গত শুক্রবার থেকে বাংলাদেশী কর্মীদের বিষয়ে মালদ্বীপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এরপরও কর্মীদের পুলিশী আতঙ্ক কাটছে না। কর্মীরা ১০ দিন ধরে কোন কাজেও যেতে পারছেন না। এখন তাদের অনেকের জমানো খাদ্যও শেষ হয়ে আসছে। এভাবে আরও কয়েকদিন যদি চলে তাহলে বাংলাদেশী কর্মীদের চরম বিপর্যয় দেখা দেবে। গত রবিবার ভোরে চার মুখোশধারীর হামলায় প্রবাসী বাংলাদেশী শাহীন মিয়া খুন হন। শাহীন মালের সাউথ-ওয়েস্ট হারবার এলাকায় ‘লিয়ানু ক্যাফে’তে কাজ করতেন। আর ‘আলিফ আলিফ আতোল থড্ডু’ দ্বীপ থেকে বিল্লাল নামে অন্য এক বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে কর্মীরা প্রতিবাদমুখী হয়ে ওঠে। তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত ১০টার দিকে বিল্লালের ঘরে তার চাকরিদাতা হোসেইন হাসান লাশটি দেখতে পান। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ সেখান থেকে বিলালের লাশ উদ্ধার করে। বিল্লালের সঙ্গে ওই বাসায় আরও তিনজন প্রবাসী থাকতেন। মালদ্বীপ থেকে কয়েকজন কর্মী অভিযোগ করেন, দেশটির পুলিশ মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোন কথাই বলেনি। এছাড়া এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি। অন্যদিকে শাহিন মিয়া খুনের বিষয়েও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করার চেষ্টাও করেনি। মালদ্বীপ বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর আরও তিনটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাভিরি হিংগুনের টেপকন হার্ডওয়ারের সামনে অজ্ঞাত কয়েকজন এক বাংলাদেশী কর্মীর ওপর আক্রমণ করে। এতে ওই কর্মী মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনার একটু পরই একই এলাকায় আরেকজন বাংলাদেশী কর্মীর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে। একই দিন এক ভারতীয় কর্মীকে ছুরি মারা হয়। এই তিন ঘটনারও কোন প্রকার ব্যবস্থা নেইনি পুলিশ। এ কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ক্ষোভে ফুসে ওঠে। তারা কয়েক দফা বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঘটনার প্রতিবাদে স্মারকলিপি দিয়েছেন। হাইকমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এতে বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে আরও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। কর্মীরা পৃথক ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করলে পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর কঠোর অবস্থান নেয়। পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের ভিসা বাতিলসহ দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয়। বিষয়টি মালদ্বীপ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মালদ্বীপের অনলাইন নিউজ পেপার হাভেরুকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই তিন প্রবাসীর ওপর হামলার সঙ্গে শাহীন মিয়া হত্যাকা-ের কোন যোগাযোগ আছে কি-না তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। শাহীনকে হত্যার আগের দিন রাতে একদল যুবক ওই ক্যাফেতে গিয়ে বিনা পয়সায় কফি চাইলে কর্মীদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। পরে ওই যুবকরা ক্যাফেতে ভাংচুর চালায়। এ ঘটনার পরদিন শাহীন মিয়া খুন হন। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় সেখানে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের দশজন মতো কর্মী খুন হয়েছেন। অন্যদিকে মালদ্বীপের ইমিগ্রেশন কনট্রোলার মোহামেদ আনওয়ার এ বিষয়ে প্রবাসীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ওয়ার্ক পারমিটের শর্ত অনুযায়ী কোন প্রবাসী প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করতে পারবেন না। যদি এ ধরনের কাজ করে তাহলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশনকে জানিয়ে দিয়েছে। যদি কোন কর্মী বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে তাহলে তাদের ভিসা করা হবে। মালদ্বীপ পরিস্থিতির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেখানে হেল্প লাইন চালু করা হয়েছে। এই হেল্প লাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। যে কেউ যে কোন সময় এই হেল্প লাইনে ফোন করে সব ধরনের সহযোগিতা পেতে পারবেন। এ ঘোষণার পর কর্মীদের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছে। এরপর অনেক কর্মী ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মালদ্বীপের বিষয়টি জানার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মালদ্বীপে যেসব কর্মী কাজ করেনÑ তাদের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এ কাজটি মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মালদ্বীপে কর্মীদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা হেল্প লাইন চালু রেখেছে।
×