ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ মার্চ ২০১৫

জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের কথা

॥ দুই ॥ মহিউদ্দিন আহমেদ পতাকার প্রেক্ষিতটি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সঙ্গে আরও অনেকের বিবরণের মিল রয়েছে। কিছু কিছু অমিলও আছে। কিছু বিভ্রান্তিও আছে। সেজন্য আরও কিছু উদ্ধৃতি যুক্ত করা যেতে পারে। বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র বইতে কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছেন, ১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেয়ার কর্মসূচী নেয়া হয়। ঐদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে, একটা বাহিনী গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। এবারও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় আ স ম আবদুর রবকে। নিউক্লিয়াস থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ’ হিসেবে প্রদান করা হবে। ৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই। এই ফ্ল্যাগ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন, এই পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি। বটলগ্রিন জমিনের ওপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এই নকশা নিউক্লিয়াস হাইকমান্ডের অনুমোদন নেয়া হয়। তখন আমি প্রস্তাব করি যে, এই পতাকাকে পাকিস্তানী প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত।... পতাকার কাপড় কিনে তৈরি করতে পাঠানো হয় কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, মনিরুল হক, হাসানুল হক ইনু ও শহীদ নজরুল ইসলামকে। তারা নিউমার্কেটের এ্যাপোলো নামক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের পাক ফ্যাশন থেকে তৈরি করে নেয়। যে দর্জি এই পতাকা তৈরি করেন তিনি ছিলেন অবাঙালী এবং ইতিবৃত্ত না জেনেই এই পতাকা তৈরি করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ঐ দর্জি পাকিস্তানে চলে যান। সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালি মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এই সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাস (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নম্বর কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে এ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালি রং কিনে আনা হলো। শিবনারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালি রং। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হলো। যে ক’টি বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে ইকবাল হলের ১০৮ নম্বর কক্ষে কোন কাজ হয়েছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। মহিউদ্দিন আহমদ পতাকা তৈরির জায়গা হিসেবে ১১৮ নম্বর রুমের কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকেই সেই রুম নম্বরটিকে ১১৬ নম্বর বলে শনাক্ত করেছেন। তবে পতাকার কাপড় কেনার বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমদ অন্য কথা বলেছেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, মনিরুল ইসলাম ছাত্রলীগের নেতা রফিকুল ইসলামকে কাপড় যোগাড় করতে বললেন। রফিকুল ইসলাম ছাত্রলীগের মধ্যে লিটল কমরেড নামে পরিচিত ছিলেন। রফিক জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নজরুল ইসলামকে নিয়ে নবাবপুর চষে বেড়ালেন, কিন্তু কালচে সবুজ রঙের কাপড় পেলেন না। অগত্যা তাঁরা এলেন নিউমার্কেটে। নিউমার্কেট সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বন্ধ ছিল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিউমার্কেটের এ্যাপোলো ফেব্রিক্সের মালিক লস্কর সাহেবের ছেলে ইকবাল ছিলেন রফিকের বন্ধু। রফিক তাদের বাসায় গিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। ইকবালের বাবা দোকানের চাবি দিয়ে দিলেন। ইকবালকে নিয়ে রফিক আর নজরুল আবার নিউমার্কেটে গেলেন। কাপড় নিয়ে তাঁরা সোজা গেলেন বলাকা বিল্ডিংয়ের তিন তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে একটা দর্জির দোকানে। দোকানের নাম পাক ফ্যাশন টেইলার্স। ওই দোকানের অবাঙালী দর্জি মোহাম্মদ হোসেন, নাসির উল্লাহ ও আবদুল খালেক মোহাম্মদী পতাকাটা সেলাই করে দেন। সেলাই শেষ হলে তাঁরা চলে আসেন ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকতেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। এবারে মহিউদ্দিনও নিশ্চিত করলেন যে, কক্ষ নম্বরটি আসলে ১১৬। একই সঙ্গে পাক ফ্যাশনের যেসব দর্জি পতাকাটি সেলাই করেন তাদের নামও পাওয়া যায়। আমরা যারা সেই সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম তারা এই দর্জির দোকানটিকে পছন্দ করতাম। আমাদের অনেক কাপড় এই দোকানেই তৈরি হয়েছে। ফলে দর্জিরা অবাঙালী হয়েও কোন দেশের কি পতাকা বানিয়েছিল সেটি মোটেও ভাবেনি। পতাকা সম্পর্কে এক বেসরকারী টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে শাজাহান সিরাজ বলেন, ‘রব ভাই প্রস্তাব দিয়েছে জমিন। এর আবার মধ্যস্থতা করে দিল আমাদের মার্শাল মনি। তারপর এক্সেপ্ট হয়ে গেল। আরেফ ভাই তখন আমার কাছে উদ্ভট মনে হওয়া একটা প্রস্তাব দিল। বাংলাদেশের, পূর্ব পাকিস্তানের, একটা ম্যাপ দিতে হবে।’ আ স ম আবদুর রব লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল। ১১৬ নম্বর কক্ষে থাকতাম। এ কক্ষে বসে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালীর আর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে আমি, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি বাঙালী জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পতাকা তৈরির পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ আঁকতে জানে না। সবাই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন সম্ভবত শাজাহান সিরাজ জানান, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাস ঢাকায় আছে। সে ভাল পোস্টার লেখে। সবাই আলোচনা করে পতাকার কাঠামো তৈরি করেন। মানচিত্র অঙ্কন করেন শিবনারায়ণ দাস। ওপরের কিছু তথ্য বাংলা নিউজ২৪ নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্য কাজী আরেফ আহমেদের কন্যা কাজী আফরিন জাহান জুলির লেখার অংশবিশেষ। আমি তার যোগাড় করা তথ্যের সঙ্গে নতুন আরও কিছু তথ্য যোগ করেছি। ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, তৎকালীন ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী নেতৃবৃন্দ যারা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন তারাই ’৭০ সালের ৬ জুন রাতে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য ও তার মাঝে সোনালি রঙের বাংলার মানচিত্র দিয়েই পতাকাটি তৈরি করেন। পতাকার কাপড় যোগাড় করেন রফিকুল ইসলাম। ৪২ক বলাকা ভবনে অবস্থিত ছাত্রলীগ অফিসের পাশের পাক ফ্যাশন থেকে পতাকা সেলাই করে তাতে শিবনারায়ণ দাস সোনালি মানচিত্র আঁকেন। সেই পতাকা জয় বাংলা বাহিনী, বটতলা, পল্টন ময়দান, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়। আমরা তখনই জানতাম মানচিত্রটি এটি বোঝানোর জন্য যে আমরা বাংলাদেশ মানে পশ্চিমবঙ্গকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকেই বাংলাদেশ বানাতে চাই। মানচিত্রের বিষয়টি সম্ভবত আরও স্পষ্ট করতেই হবে মূলত ভারতকে আশ্বস্ত করাটাই মানচিত্র রাখার প্রধান কারণ ছিল। আমরা বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলছিলাম। বাঙালী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাও এই সংজ্ঞায় পড়ে। আমরা বাংলা ভাষার কথা বলছিলাম। এটাও ভারতের এই অংশটিকে সম্পৃক্ত করে। আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলছিলাম। তখন এই অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন চলছিল। আমাদের যাতে সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না করা হয় সে জন্যও মানচিত্রটির প্রয়োজনীয়তা ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশটি এই পতাকার রূপরেখা নিয়ে রাজপথে, চায়ের আড্ডায়, জহুর হলে, মধুর ক্যান্টিনসহ সর্বত্রই আলোচনা করেছে। পতাকার জন্মদিনের আগেই এর রং ও রূপরেখা কর্মীস্তরেও গৃহীত হয়। পতাকার আয়তাকার আকৃতির সঙ্গে মাঝখানে লাল রঙের বৃত্তটি জাপানী পতাকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবে। আমরা তখন জাপানকে সম্মানের সঙ্গে দেখিÑ নেতাজী সুভাষ বসুর কথাও তখন আমাদের চিত্তে প্রভাব বিস্তার করে। আমরা তখন সবুজ সোনার বাংলার স্বপ্নেই বিভোর। আমাদের এই অংশটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে আমার সোনার বাংলা রাজপথেই গেয়েছে। যারা পতাকার এই ইতিহাসটুকু জানলেন তাদের আরও জানা উচিত কেমন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয় বা কেমন করে জয়বাংলা সেøাগানের জন্ম হয়। একই সঙ্গে এটি জানা দরকার যে, স্বাধীনতার লড়াইকে সশস্ত্র করার কাজটা খুব মসৃণ ছিল না। এমনকি ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ এর বিরোধিতাও করেছে। ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন অংশটি ছাত্রলীগের সভায় স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে এবং তৎকালে সক্রিয় অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগের এই অংশের কর্মকা-কে হঠকারিতা বলেও চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে সেই অধ্যায়গুলোও জানতে হবে। অন্যদিকে এটিও বলা দরকার যে, দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর মনে করা হয় যে, পতাকায় মানচিত্র থাকার প্রয়োজন নেই। সেই মতে পতাকার রং, বৃত্ত, অনুপাত ও মাপটি চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের করা। পাঠকের কাছে অন্যরকম মনে হলেও আরও জানতে হবে এই পতাকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা। একই সঙ্গে জানতে হতে পারে। ঢাকা, ২৭ মার্চ ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ:www.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com
×