ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি জনবল নিয়োগ

নির্ধারিত সময়ে লাখ লাখ প্রবাসীকে এমআরপি দেয়ার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৮ মার্চ ২০১৫

নির্ধারিত সময়ে লাখ লাখ প্রবাসীকে এমআরপি দেয়ার উদ্যোগ

ফিরোজ মান্না ॥ চলতি বছরের নবেম্বরে শেষ হচ্ছে এমআরপি দেয়ার সময়সীমা। এই সময়ের মধ্যে এমআরপি হাতে না পেলে লাখ লাখ প্রবাসীকে দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এমআরপি দেয়া সম্ভব হবে না বলে জানায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইকাওয়ের প্রেসিডেন্টের কাছে সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। আইকাও প্রেসিডেন্ট অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে সাফ জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে আইকাওয়ের আর কিছু করার নেই। আইকাওয়ের এই জবাবের পর নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ সরকার। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ওই ঘোষণার পর বেশ কয়েক দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। এখন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর বলা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রবাসীদের হাতে এমআরপি তুলে দেয়া সম্ভব হবে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই এমআরপির কাজ শেষ করার জন্য বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব শহিদুল হক জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রতিটি দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এমআরপি প্রবাসীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হবে। এমআরপির জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব দেশে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি সেসব দেশে মোবাইল টিম কাজ করবে; যাতে কর্মীদের কষ্ট করে দূতাবাস বা হাইকমিশনে আসতে না হয়। এমআরপি নিয়ে বৈঠকে দূতাবাস ও হাইকমিশনের কোন প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতির খবর পাওয়া গেলে অনিয়মকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। তাদের কথা চিন্তা করেই এমআরপির কাজটি দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর বাংলাদেশের প্রস্তাব নাকচ করেছে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও)। চলতি বছরের ২৪ নবেম্বরের পর থেকে হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ কিংবা বিদেশে অবস্থান করা যাবে না। ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী কর্মীরা। সরকারী হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ প্রবাসীর হাতে এমআরপি নেই। মাত্র ২৫ শতাংশ প্রবাসীকে গত পাঁচ বছরে এমআরপি দেয়া সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া এমআরপি দেয়া নিয়ে দূতাবাস ও হাইকমিশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা- কর্মচারীর প্রবাসীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমআরপি প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশে দূতাবাস ও হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কোন প্রকার সহযোগিতা দিচ্ছেন না। কারণ এমআরপি প্রকল্পের মাধ্যমে পাসপোর্ট দেয়া হলে হাইকমিশন ও দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোন লাভ হয় না। তাই তারা সহযোগিতাও দিচ্ছেন না। এমন অভিযোগ অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেছেন, এমআরপি দেয়ার বিষয়ে দূতাবাস ও হাইকমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কারণ একজন কর্মী তার কাজ বাদ দিয়ে বার বার দূতাবাসে আসতে চান না। তাই কর্মীরা টাকা দিয়েই এমআরপি নিচ্ছেন। তাছাড়া অনেক কর্মী দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে অনেকদূরের শহরে কাজ করেন, তারা এমআরপির জন্য প্রতিদিন দূতাবাসে ঘুরতেও চান না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ মহলও জানে। কিন্ত জেনেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। একটাই কথা, আগে এমআরপি হোক। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি বলেন, এমআরপি নিয়ে ২০১৫ সালে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ সম্পর্কে আরও দুই বছর আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো বিষয়টি নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ায় প্রবাসীদের বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে। মন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র ও বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়কে, মোবাইল টিম গঠন করে প্রবাসীদের হাতে এমআরপি দেয়ার জন্য। এই দু’টি মন্ত্রণালয় ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে কাজটি শেষ করতে পারত। এখন যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা সহজেই এড়ানো সম্ভব হতো। বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যথাসময়ের মধ্যেই এমআরপি প্রবাসীদের হাতে তুলে দেয়া হবে। আইকাওয়ের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই এমআরপি দেয়া হবে। মন্ত্রণালযের নির্দেশে গত ১৪ জানুয়ারি কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কামরুল আহসান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ট্রিলে আইকাও প্রেসিডেন্ট ওলুমইয়া ব্রান্ড অলিউরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর চলতি বছরের ২৪ নবেম্বরের আগে এমআরপি পাসপোর্ট দেয়ার বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। হাইকমিশনার বলেন, গত মাস পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ প্রবাসীকে এমআরপি পাসপোর্ট দেয়া সম্ভব হয়েছে। এ অবস্থায় আরও ৭৫ শতাংশ প্রবাসীকে পাসপোর্ট দিতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যেতে পারে। এ কারণে তিনি এমআরপি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা এ বছরের ২৪ নবেম্বর থেকে বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ২৪ নবেম্বর করার অনুরোধ জানান। হাইকমিশনারের এই অনুরোধ আইকাও প্রেসিডেন্ট নাকচ করে দিয়েছেন। আইকাও প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে বলেন, আইকাওয়ের কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলে আইকাও কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত প্রয়োজন। কিন্ত আইকাওয়ের গ্রীষ্মকালীন কাউন্সিল অধিবেশনের আলোচ্যসূচীতে এ ধরনের কোন এজেন্ডা ছিল না। এ জন্য চলতি বছরের ২৪ নবেম্বরের মধ্যে হাতে লেখা পাসপোর্ট ব্যবহার করা যাবে। এরপর আর হাতে লেখা পাসপোর্ট ব্যবহার করা যাবে না। আইকাও প্রেসিডেন্টের নাকচ করার বিষয়টি কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে গত ৮ ফেব্রুয়ারি জানিয়ে দিয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে কোন মন্ত্রণালয়ই করণীয় কি হবে তা নিয়ে বৈঠক আহ্বান করেনি। উল্টো আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করা নিয়ে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। কোন্ মন্ত্রণালয় এই বৈঠক ডাকবে এ নিয়ে ঠেলাঠেলি তৈরি হয়। এ অবস্থায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র এবং বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়কে দোষ দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ওই দুই মন্ত্রণালয়ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদিশক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওপর দোষ চাপিয়েছে। এই জটিল সমস্যা নিরসনে কোন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কার্যকর কোন উদ্যোগই দৃশ্যমান হয়নি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আরও দুই বছর আগে থেকে উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দিয়ে বিষয়টি সমাধানের অনুরোধ করা হয়। এর চেয়ে ইেশ কিছু করার সাধ্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেই। মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে মোবাইল টিম গঠন করে এমআরপি প্রদানের কথা বলা হয়। এমআরপির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার টাকা ও লোকবল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেবে, তাও বলা হয়েছে। ঢাকা থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ হাজার এমআরপি প্রিন্ট করার ক্ষমতা রয়েছে। সদিচ্ছা থাকলে জরুরী ভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়ে চলতি বছরের নবেম্বরের মধ্যেই ৯০ শতাংশ প্রবাসীকে এমআরপি দেয়া সম্ভব।
×