ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংস্কৃতিক জোটের স্বাধীনতা উৎসব শুরু

ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রুজাল শত্রুজাল শত্রুজাল...

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৫ মার্চ ২০১৫

ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রুজাল শত্রুজাল শত্রুজাল...

মোরসালিন মিজান ॥ এই পথ-/ হয় হোক রক্তের প্রচ্ছদপট/ তবু করি না করি না করি না ভয়/ ... জয় বাংলা বাংলার জয়। বাংলার-ই জয় হয়েছিল। বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাঙালী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু স্বপ্নের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর আজকের বাংলাদেশ। না, লড়াই এখনও শেষ হয়নি। পাকিস্তানী ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে। স্বাধীনতা দিবস ২০১৫ সামনে রেখে একইভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথা জানালেন সংস্কৃতিকর্মীরা। মঙ্গলবার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত বিজয় উৎসব থেকে এই অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হওয়া উৎসবের স্লোগান- ‘সন্ত্রাস নাশকতা- রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’। দুই দিনব্যাপী আয়োজনে কবিতা নাচ গান নাটকের ভাষায় শ্রদ্ধা জানানো হবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। শহীদদের স্মরণ করা হবে। সেইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন শপথ নেবেন সংস্কৃতিকর্মীরা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রধান আয়োজনগুলোর একটি স্বাধীনতা উৎসব। বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের উপস্থিতিতে বিকেলে এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণকারী পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা বাঙালী বীরদের কয়েকজন। এঁদের মধ্যে ছিলেনÑ তৎকালীন ওয়্যারলেস অপারেটর মোঃ শাহজাহান মিয়া, নায়েক আবুল ফারুক, কনস্টেবল কাঞ্চন আলী মিয়া, জহুরুল হক জহির, নুরুল ইসলাম ও মুখসেদ আলী। সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন তাঁরা। প্রত্যেকেই এখন প্রবীণ। শরীরের কাঠামো দুর্বল। মাথার চুল সাদা। সফেদ পাঞ্জাবি পাজামা পরা। মাথায় নামাজের টুপি। দেখে মনেই হয় না, এই মানুষগুলো বিরল ইতিহাসের স্রষ্টা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এই এঁরাই পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, দেখে অনুমান করা শক্ত। বাঙালীর গৌরবের ইতিহাসের স্রষ্টারা সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছিলেন। এদিন সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মান্নান হীরা প্রমুখ। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেই দিনের কিছু কথা আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেন শাহজাহান মিয়া। কাজের মানুষ বলেই হয়ত কথা অতো আসে না। তবে যা বললেন, ভেতর থেকে। কণ্ঠেও একটা উত্তেজনা ছিল। আত্মবিশ্বাস ছিল। শাহজাহান মিয়া জানালেন, এই উত্তেজনা আত্মবিশ্বাস তাঁরা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। বক্তৃতার শুরুতে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেই আমরা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে সাড়ে ১০টার দিকে আমরা সংবাদ পাই, আজ রাতে পাকিস্তানী বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করবে। বার্তাটি পাওয়ার পরই আমরা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেই। কোন উর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করেননি কেউ। তখনই পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। সাধারণ সৈন্যরা নিজে উদ্যোগী হয়ে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাই। সকলে প্যারেডগ্রানউন্ডে সমবেত হয়ে সেøাগান দিতে থাকিÑ বীর বাঙালী অস্ত্র ধর/ বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা। তিনি বলেন, আমাদের হাতে একটি করে থ্রিনট থ্রি রাইফেল। সাধারণ এই অস্ত্র নিয়েই প্রাণপণ লড়ে যাই। আমাদের একটি গুলির বিপরীতে পাকিস্তানী সৈন্যরা অসংখ্য গুলি চালায়। তবু আমরা পিছু হটিনি। ৫০০ থেকে ৭০০ বাঙালী সৈন্য সাড়ে ৩ ঘন্টা লড়েছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে শহীদ হন প্রায় ১৫০ জন। শাহজাহান যখন কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন সন্ধ্যা। বিদ্যুতের আলো অল্প অল্প করে তাঁর চোখের ওপর পরছিল। আর তখন দেখা গেল, বৈদ্যুতিক বাল্বের চেয়েও যেন বেশি জ্বল জ্বল করছে তাঁর দুচোখ। সেখানে সামান্য জল। ভেজা চোখ। বললেন, ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার পর বিপন্ন বোধ করেছিলেন তাঁরা। দেশ যেন ভবিষ্যতে আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির হাতে না যেতে পারে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। এদিন সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ফকির আলমগীর, মান্নান হীরা প্রমুখ। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলেন, আজকের বাংলাদেশে নতুন এক লড়াই চলছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল বাঙালী। এখন লড়তে হচ্ছে স্বাধীনতা ধরে রাখার জন্য। যে কোন অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা লড়তে প্রস্তুত বলে জানান বক্তারা। এর আগে সংস্কৃতিকর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গান জাতীয় সঙ্গীতÑ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...। গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীরা গেয়ে শোনান স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। আজকের বাংলাদেশের শত্রুদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেই যেন তাঁরা গেয়ে যান- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/ রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল... ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রুজাল শত্রুজাল শত্রুজাল...। একক আবৃত্তির মাধ্যমে একই আহ্বান জানান কবি মুহাম্মদ সামাদ। দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চলে রাত পর্যন্ত। আজ বুধবারও থাকবে একই রকম আয়োজন। স্বাধীনতা উৎসব একযোগে চলেব রবীন্দ্রসরোবরেও।
×