ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিন সিটি নির্বাচন ॥ ঢাকায় ৮ শতাংশ বিলবোর্ড অপসারণ

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য সব প্রার্থী মাঠে ॥ বিএনপির গোপন প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২১ মার্চ ২০১৫

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য সব প্রার্থী মাঠে ॥ বিএনপির গোপন প্রস্তুতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য সব প্রার্থীই এখন নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য সব প্রার্থীই নির্বাচনের মাঠ গরম করছেন। অপরদিকে বিএনপি এ নির্বাচনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না নিলেও গোপনে গোপনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিলেও কাউন্সিলর পদে অনেক প্রার্থীই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপি যে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দেবে না সে কথা অনেকখানি স্পষ্ট করলেন জোটের থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ। শুক্রবার রাতে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে গুলশান কার্যালয়ের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের এমন আভাসই দিলেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে চেয়ারপার্সনের মনোভাব ইতিবাচক। তবে সিদ্ধান্ত আসবে ২০ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে। এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, বুধবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত কমসংখ্যক প্রার্থীই নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট খেলার জন্য কোন মেয়র প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি। এছাড়া শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভিড় করেননি। তবে আজ শনিবার থেকে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহে ভিড় বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র সংগ্রহের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কোন মেয়র প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি। কাউন্সিলর পদে বেশিরভাগ প্রার্থী নির্বাচনী আইনকানুন জানার জন্য কার্যালয়ে ভিড় করেন। মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ভোটার তালিকার সিডি সংগ্রহ, জামানত, ব্যাংক হিসাব খোলা, টিআইএন নম্বর নেয়া, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যক্তিগত ব্যয়সহ নানা বিষয়ে জানতেই প্রথম দিকে ভিড় করেন প্রার্থীরা। তফসিল ঘোষণার পরই প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচার। প্রার্থীরা দ্বারে দ্বারে ভোটারদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছেন। এছাড়া ভোটারদের সমর্থন নেয়ার জন্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে পাড়া-মহল্লায় লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে। শুক্রবার মসজিদে মসজিদে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ থেকে দোয়া চাইতে দেখা গেছে। এদিকে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়লেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোন প্রার্থীকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে জানা গেছে, নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনও কোন সিদ্ধান্ত দেয়া না হলেও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য অনেকেই সক্রিয় রয়েছেন। দল সিদ্ধান্ত জানালে তাঁরা পুরোদমে নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়বেন। আর যদি দলের পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া না হয় তাহলে এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দলের মধ্যে দুই মত রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে দল কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন গোপনে গোপনে নির্বাচনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। দল সিদ্ধান্ত দিলেও তিনি সক্রিয় প্রচার চালাবেন। এছাড়া অর্থ সম্পাদক আব্দুস সালাম সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। উত্তরের জন্য বিএনপির কোন প্রার্থী সক্রিয় না থাকলেও দল সিদ্ধান্ত নিলে আব্দুল আওয়াল মিন্টুকে প্রার্থী করা হবে বলে জানা গেছে। ওদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বর্তমান মেয়র মঞ্জুর আলম। অপরদিকে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য সব প্রার্থীই নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এ নির্বাচনে যেহেতু বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই ভোটার, তাই বিএনপি কাউকে না কাউকে সমর্থন করবেই। এদিকে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে বিএনপি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। ঢাকার উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য গত বুধবার তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চ পর্যন্ত কোন প্রার্থীর পক্ষে কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ বা জমা দিতে পারবেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ঢাকার উভয় সিটিতে একজন করে রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং দক্ষিণের জন্য ১৯ জন ও উত্তরের জন্য ১২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদ। উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ শাহ আলম। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনে যেসব প্রার্থী আগাম প্রচারে নেমেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আজ থেকে অভিযান চালানো হবে। বিশেষ করে যেসব প্রার্থীর পক্ষ থেকে আগাম প্রচারের নামে রাজধানীতে বিলবোর্ড, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রার্থীদের স্ব উদ্যোগে এসব বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে ফেলার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। শুক্রবার রাত বারোটায় এ সময়সীমা শেষ হয়েছে। আজ থেকে যেসব প্রার্থী এখনও আগাম প্রচারের পোস্টার সরিয়ে নেননি তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ পোস্টার ও বিলবোর্ড সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যে স্ব উদ্যোগে প্রচার ও শুভেচ্ছামূলক বাকি পোস্টার অপসারণ এবং দেয়াল লিখন মুছে ফেলার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ শাহ আলম বলেন, পুরো নির্বাচনী এলাকায় আগাম প্রচারমূলক পোস্টার-ব্যানার-বিলবোর্ড-দেয়াল লিখন রয়েছে কিনা তা তদারক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ অপসারণ হয়েছে। শুক্রবার রাত ১২টার মধ্যে অপসারণ না হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ কাজে সহায়তার জন্য সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, এ এলাকায়ও প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ আগাম প্রচারের পোস্টার সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের তিন সিটিতে নির্বাচনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে গত নির্বাচনের চেয়ে তিনগুণ। কমিশনের বাজেট শাখা থেকে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য ৪০ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসির ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ২০০২ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচয়ে ব্যয় হয়েছিল ১৩ কোটি টাকা। এবার এ ব্যয় তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৭ কোটি টাকা। এবারের এ ব্যয়ও তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচন উপকরণ বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এ ব্যয় ধরা হয়েছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সম্মানী আগের চেয়ে তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী বাজেটের বেশিরভাগ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে। জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে ইসির সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬০ কোটি টাকার মধ্যে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয় হবে ২৫ কোটি টাকা। সিটি নির্বাচন নিয়ে খালেদা ‘ইতিবাচক’ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে রাত পৌনে নয়টায় বের হয়ে সাবেক ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে চেয়ারপার্সনের মনোভাব ইতিবাচক বলে তাঁর মনে হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিএনপি বরাবরই একটি নির্বাচনমুখী দল। তাই এ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার আশ্বাস পেলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বিএনপির ফোরাম হচ্ছে দলের স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি। সেখানেই নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা দেবে। এ সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের প্রতি বিএনপি বেশি নজর দিচ্ছে। এমাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে নয় সদস্যের প্রতিনিধি দল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গুলশান কার্যালয়ে যায়। কার্যালয়ের গেটে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা নিবন্ধন খাতায় নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ শেষে তাঁদের অপেক্ষা করতে বলেন। পরে কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়। প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, ঢাবির সাবেক প্রো-ভিসি আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান, অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক মামুন আহমেদ, অধ্যাপক তাহমিনা আখতার টফি ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল হাই শিকদার। নির্বাচনে অংশ নিলে আন্দোলন কর্মসূচীর কী হবে জানতে চাওয়া হলে এমাজউদ্দীন বলেন, দলের স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে চলমান আন্দোলনের ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। তিনি জানান, বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ ১০ দিন ধরে নিখোঁজ থাকায় বেগম জিয়া তাঁর উদ্বেগের কথা তাঁদের জানিয়েছেন।
×