ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারীর ক্ষমতায়নে কম ওজনের অপুষ্টি শিশুর সংখ্যা কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২০ মার্চ ২০১৫

নারীর ক্ষমতায়নে কম ওজনের অপুষ্টি শিশুর সংখ্যা কমেছে

নিখিল মানখিন ॥ দেশে কম ওজনের অপুষ্টি শিশুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। হ্রাসের এ হার শহরে ৫৩ ভাগ এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৭ ভাগ। ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও বিভিন্ন সেক্টরে নারীর অগ্রগতি এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে স্থূল শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত ১৯৯৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে ২০১৫ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন আইসিডিডিআরবির গবেষকরা। দেশের ৪০ হাজারের বেশি শিশুর ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিডিডিআরবির সহকারী বৈজ্ঞানিক ডাঃ সুমন কুমার দাসের নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী এ গবেষণা চালান। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত দারিদ্র্যদূরীকরণ, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি এবং পুষ্টিবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমও কম ওজনের অপুষ্টি শিশুর সংখ্যা হ্রাসে সহায়ক হয়েছে। তবে গবেষণায় স্থূলতার বিষয়ে সতর্কবার্তা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে স্থূলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধি পাওয়া স্থূলতার সঙ্গে অপুষ্টির বেশ সম্পর্ক রয়েছে। গত ১৯৯০ সাল থেকেই অপুষ্টির কারণসমূহের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের কম ওজনের অপুষ্টি শিশুর সংখ্যা হ্রাসের পেছনে বেশকিছু ফেক্টর কাজ করেছে। দেশে মাতৃশিক্ষার হার বেড়েছে। মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের মধ্যেও আয় করার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, নিজেদের বাগানে শাক-সবজি উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এত কিছু উন্নতির পরও কম ওজনের ও স্থূল শিশুরাও চিন্তার বিষয়। পুষ্টি কার্যক্রম ও প্রভাব ॥ শিশু পুষ্টি কার্যক্রম আরও জোরালো করেছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক চিঠি পাঠিয়েছে। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শিশু পুষ্টি কার্যক্রমেও নতুন কর্মসূচী আসছে। যথাযথ খাদ্যাভ্যাস বিশেষ করে নবজাতক ও শিশু খাদ্যাভাস অনুশীলনের মাধ্যমেই এই অপুষ্টির সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন পুষ্টি বিজ্ঞানীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোহাম্মদ নূরুল হক জানান, শিশু পুষ্টি কার্যক্রম আরও জোরালো করেছে সরকার। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের মধ্যেই এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নের ওপর অপুষ্টির রয়েছে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব। যথাযথ খাদ্যাভ্যাস বিশেষ করে নবজাতক ও শিশু খাদ্যাভাস অনুশীলনের মাধ্যমেই এই অপুষ্টির সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব। অপুষ্টিতে মা ও শিশুরা ॥ মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যে দৃশ্যমান সাফল্য এলেও সে তুলনায় অপুষ্টির হার কমছে না। বাংলাদেশে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে শতকরা ১৪ ভাগ রয়েছে ভয়াবহ অপুষ্টিতে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ডভিশন নামে একটি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১২ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার সূচকে ৭৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৬৮ নম্বরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে নবজাতকের রোগে শতকরা ৫৯ ভাগ শিশু মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১১ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম বা খর্বাকৃতির, ১৬ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় রুগ্ণ এবং বয়সের তুলনায় ওজন কম ৩৬ শতাংশ শিশুর। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে (২০০৯) বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ শিশু ও ৪০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। এছাড়া সন্তানদানে সক্ষম তিন নারীর একজন অপুষ্টির শিকার। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার পর থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের পাশাপাশি সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। শিশুকে প্রতিদিন কমপক্ষে চার ধরনের খাবার খাওয়ানো উচিত। প্রাণিজ, ভিটামিন সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাক-সবজি, দুগ্ধজাত, তেল ও চর্বি জাতীয়, মটরশুঁটি ও ডাল এবং শস্য দানা জাতীয় খাবার থাকা প্রয়োজন। প্রাণিজ খাবারের মধ্যে ডিম, মাংস, কলিজা ও মাছ থেকে দৈহিক ও মেধা বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক শক্তি এবং ভিটামিন ও খনিজ উপাদান (আয়রন ও উচ্চমানের আমিষ) পাওয়া যায়। শিশু ও মাকে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার মাছ, গাজর ও গাঢ় শাক-সবজি খাওয়ানো উচিত। আয়রন ঘাটতি রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান কারণ। রক্তস্বল্পতার ফলে শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বাধা পায়। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার কলিজা, মাছ ও গাঢ় সবুজ শাক-সবজি খাওয়ানো দরকার। ১৮১ দিন থেকে শুরু করে ৮ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুকে পরিবারের অন্যদের মতো খাবার খাওয়ানো শুরু করা উচিত। এজন্য দিনে দু’বার ২৫০ মিলিলিটার (এক পোয়া) বাটির অর্ধেক বাটি শক্ত বা নরম খাবার খাওয়ানো পাশাপাশি দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ৯ মাসের শুরু থেকে ১১ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিনে তিনবার ২৫০ মিলি বাটির অর্ধেক বাটি খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ১২ মাস থেকে ২৩ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিনে তিনবার ২৫০ মিলি বাটির পুরো বাটি খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া দিনে দু’বার পুষ্টিকর হালকা খাবার খেতে দিতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ঢাকায় জাতীয় উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের সভাপতি এস কে রায় জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুর যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। আর জন্মের ৬ মাস পর শিশুকে বাড়তি খাবার খাওয়াতে শুরু করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার বলতে শুধুমাত্র দামি খাবারকে বুঝায় না। অনেক পুষ্টি উপাদান বাড়ির আশপাশেই রয়েছে, যা স্বল্পমূল্যে সংগ্রহ করা সম্ভব। পারিবারিক খাবার থেকেই আলাদা করে (নরম ও গুঁড়া করে মাখিয়ে ) শিশুকে দেয়া যায়। তিনি বলেন, মায়ের দুধের পরিবর্তে কৌটার বা বাজারের দুধ খেলে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে এ শিক্ষাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে পুষ্টি ধারণা বাড়বে এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ও মায়ের সংখ্যা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
×