ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

সার্বিক অর্থনীতি, বিদেশী ঋণ ও আবাসন শিল্প

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২০ মার্চ ২০১৫

সার্বিক অর্থনীতি, বিদেশী ঋণ ও আবাসন শিল্প

তিনটি খবর নিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই। প্রথম খবরটির শিরোনাম :‘আর্থনীতির ক্ষতি বাজেটের অর্ধেক ছাড়িয়ে গেছে।’ দ্বিতীয় খবরটির শিরোনাম : ‘বিদেশী ঋণ ব্যয়ে অনীহা।’ তৃতীয় খবরটির শিরোনাম : ‘আবাসন খাতের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদে পুনর্অর্থায়ন তহবিল চালুর দাবি।’ তিনটি খবর তিনটি কাগজে ছাপা হয়েছে। মাঝখানের খবরটি দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছে গত ১৭ মার্চ। তিনটি খবরই অর্থনীতির ওপর। সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতির ওপর যে খবরটি ছাপা হয়েছে তার উৎস ‘ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স’-এর যে প্রতিষ্ঠানটি ‘এফবিসিসিআই’ নামে পরিচিত। তার সভাপতি বলেছেন, দুই মাসাধিককাল ধরে চলমান হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে সোয়া লাখ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মোট বাজেটের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। এর অর্ধেক হয় সোয়া লাখ কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ টাকা। এই অঙ্কের সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন। কেউ বলতে পারেন বেশি, কেউ কিছু কম।। অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ যাই হোক, ক্ষতি যে অপূরণীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন সময়ে ক্ষতিটা হচ্ছে যখন আমরা ছয়ের ঘর থেকে প্রবৃদ্ধির হার সাতে উন্নীত করতে নিয়োজিত, যখন বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে আগ্রহী। এমন একটা সময়েই অর্থনীতির সার্বিক ক্ষতি করা হচ্ছে। করা হচ্ছে নাশকতা ও বোমাবাজি করে। রাজনীতিতে এই উপাদান ভবিষ্যতে আমাদের অনেক ক্ষতিসাধন করবে। বর্তমান ক্ষতি দূর করতেও অনেক সময় লাগবে। কারণ ক্ষতিটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, চলমান নাশকতা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা। এসব ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তার হিসাব নিরূপণ করা কঠিন কাজ। এমন কী অর্থনীতির ক্ষতির হিসাবটাও। প্রার্থনা, এই সহিংসতা ও নাশকতা অবিলম্বে শেষ হোক। দেশে ফিরে আসুক স্বাভাবিক অবস্থা। কারণ, শত হোক নির্বাচনের’ দাবিতে এসব ঘটতে পারে না। চলমান ‘আন্দোলনে’ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত ও আমজনতার কোন দাবি নেই। বলা বাহুল্য, আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি না থাকলে কোন আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলন হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, চলমান সঙ্কটের মূলে মুক্তিযুদ্ধ। দ্বিতীয় যে খবরটি নিয়ে আলোচনা করা দরকার তা হচ্ছে বিদেশী সাহায্য বা ঋণ। জনকণ্ঠের রিপোর্টে অনুধাবনযোগ্য কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। বিদেশী ঋণের টাকায় গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় ধীরে। কারণ তিনটি। বিদেশী ঋণের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। নানা শর্ত পূরণে ঝামেলা হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিকতা আছে। ঐসব প্রকল্পে দুর্নীতির সুযোগ কম। এ সব কারণে পাইপ লাইনে ঋণের অঙ্ক বাড়ছে এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা বাড়ছে। এমতাবস্থায় প্রকল্প পরিচালকরা সরকারী খরচের দিকে ব্যাপক আগ্রহ দেখান। এই হচ্ছে জনকণ্ঠের খবরের সারকথা যা পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। খবরটির মূলকথা ঋণ। আমরা আমাদের উন্নয়ন বাজেট বা উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে প্রতিবছর বাজেট ঘাটতির অঙ্ক যা হয় মোটামুটি সেই পরিমাণই হয় উন্নয়ন বাজেটের আকার। অর্থাৎ প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর উন্নয়ন বাজেট। ঋণটা হতে পারে দেশীয় অথবা বিদেশী। বিদেশী ঋণ ব্যবহার করা বেশ কঠিন নানা কারণে। যার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি ঋণের টাকা ব্যবহার করা যেত তাহলে পাইপ লাইনে এত টাকা পড়ে থাকত না। তবে এ কথা ঠিক ঋণের টাকা ব্যবহারে যে শিথিলতা দেখা যায় তা উভয়পক্ষের কারণেই হয়। দাতা দেশগুলোর অতিরিক্ত খবরদারি, জবাবদিহিতা মাঝেমাধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা টাকা খরচের আগেই অনেক সময় দুর্নীতির গন্ধ পায়- যেমন পদ্মা সেতুর ঘটনা। দৃশ্যত বিদেশী ঋণের খরচ কম। কিন্তু অতিরিক্ত মনিটরিং ও জবাবদিহিতার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিলম্ব হয়, তার ‘কস্ট’ হিসাবে নিলে ঋণের সুদের হার কম হয় না। সবচেয়ে বড় কথা নিজস্ব সম্পদ। নিজস্ব সম্পদে উন্নয়ন প্রকল্প করতে পারলে সুবিধা অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থা মোটামুটি সন্তোষজনক। অনেকে মনে করেন প্রচুর ‘বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ’ মানেই প্রচুর সম্পদ। সম্পদ ঠিকই কিন্তু তা কী সরকারের? রেমিটেন্সের টাকা। রেমিটেন্স প্রাপকদের। রফতানির আয়ের টাকা রফতানীকারকদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রার একমাত্র কাস্টডিয়ান। সেই হেতু সব ডলার তার কাছে সমর্পণ করতে হয়। এর বদলে প্রাপককে ‘টাকা’ দিতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনে, বিক্রি করে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার কিনে, ডলার বিক্রি করে। এখানে সরকারের টাকা কোথায়? সরকারকেও ডলার কিনতে হবে। সরকার তা কিনবে কোত্থেকে? তার রাজস্ব আয়ের টাকা থেকে। সেই রাজস্ব আয় আসবে কোত্থেকে? আসবে ট্যাক্স, অধিকতর ট্যাক্স থেকে। এর সুযোগ কোথায়? মানুষ সাধারণভাবে কর দিতে চায় না। যেহেতু করের বিপরীতে সরকার করদাতাকে উন্নত দেশের মতো কোন সুযোগ দেয় না, অতএব মানুষ কর দিতে আরও অনুৎসাহিত হয়। এ ছাড়া মানুষ অনেক কাজ করে যেগুলো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নির্ভরশীলদের ভরণপোষণ, বেকার ভাইবোনের ভরণপোষণ, বিধবা, আত্মীয়দের ভরণপোষণ ইত্যাদি কাজ অন্য অনেক দেশে যা সরকারের কাজ। আমাদের দেশে করদাতারাই এই দায়িত্ব পালন করে। এর কারণেও অনেকেই কর দিতে দ্বিধা করে। এমতাবস্থায় অধিকতর কর আদায় করে উন্নয়ন বাজেটের টাকা যোগাড় করা এক সুকঠিন কাজ। অতএব দেশী-বিদেশী ঋণই ভরসা। দেশী ঋণ খারাপ নয়। কারণ ঋণের টাকা বেতনের জন্য খরচ করা হয় না। বেসরকারী খাতে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ অপ্রতুল হলে সরকারী খাতে উন্নয়ন হতে পারে এবং এই টাকা ঋণ থেকে আসলে ক্ষতি আছে বলে মনে করি না। এখানে ঋণের উপর সুদের হার নিয়ে এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা নিয়ে হৈ চৈ করে লাভ নেই। নিজস্ব রাজস্ব বাড়াতে না পারলে সরকার উন্নয়নের খরচ কী ভাবে নির্বাহ করবে? যদি ঋণের বোঝাই বড় বিবেচ্য বিষয় হয়, তাহলে অবশ্যই দেশের সকল সমর্থ ব্যক্তিকে কর দিতে হবে। ধনীদের বেশি দিতে হবে। বেশি ধনীদের আরও বেশি করে কর দিতে হবে। এটি ‘সোনার বাংলায়’ আপাতত সম্ভব নয়। কারণ ধনীরা কর দিতে উৎসাহী নন। তাদের বিরাট অংশ বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই দুই দেশের পাসপোর্টের মালিক। এটা এখন সামাজিকভাবে গর্বের বিষয়। ছেলেমেয়ে বিদেশের নাগরিক, ব্যবসায়ী ধনী ব্যক্তিরা দুই দেশের পাসপোর্টধারী এটা অহঙ্কারের বিষয়বস্তু। এমতাবস্থায় সরকারের পক্ষে কর আয় বাড়ানো কঠিন কাজ। তাই নয় কী? দুর্নীতির সুযোগ কম বলে বিদেশী ঋণের টাকা ব্যবহারে কর্মকর্তারা কম উৎসাহী বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার বলে মনে করি। এটা একটা ঢালাও অভিযোগ যাতে না হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শেষ খবরটা হচ্ছে আবাসন খাত সম্পর্কিত। এই খাতটি অন্যান্য খাতের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত। মুস্কিল হচ্ছে আবাসন খাত, আবার আবাসন খাত একা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১০০-১৫০ শিল্প। সারা বিশ্বে এই যে রমরমা অর্থনীতি ছিল কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তা এই আবাসন খাত নির্ভরই ছিল। আবাসন মানে নির্মাণ খাতসহ। আমেরিকার রমরমা ভাব এবং পরে ধস এই আবাসনকে দিয়েই। দুবাই ইত্যাদি দেশের আবাসন ও নির্মাণ শিল্পনির্ভর উন্নয়নই চলছে। পাশের দেশ ভারত এবং চীনের অভিজ্ঞতা একই। উত্থানও আবাসন এবং নির্মাণ শিল্প দিয়ে, এখন পতন বা ধসও একই কারণে। আমাদের আবাসন শিল্পও ব্যতিক্রম নয়। এর সঙ্গে জড়িত স্টিল, সিমেন্ট, বালি, কাঠ, রং, থাই এ্যালুমিনিয়াম, টাইলস ইত্যাদি নানা শিল্প। আবাসন শিল্প ক্ষতিগ্রস্তে। বর্তমান হরতাল-অবরোধে তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তারা কম সুদে ঋণ চান। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স চান। এক সময় কেন, এখনও আবাসন শিল্পকে উৎপাদনশীল খাত অনেকেই মনে করেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলোও ঋণ নিয়ে বেশি এগিয়ে আসে না। আমার মনে হয় বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। এই শিল্পের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পের সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করা দরকার। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×