ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্পের গতি নেই, কারণ-;###;ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা;###;সঙ্কীর্ণ সড়ক;###;চূড়ান্ত হয়নি আর্থিক যোগান;###;রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ততা;###;প্রকল্পের জন্য দুই হাজার ৪ কোটি টাকা

হায় র‌্যাপিড ট্রানজিট

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৮ মার্চ ২০১৫

হায় র‌্যাপিড ট্রানজিট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর যানজট নিরসনে বহুল প্রতীক্ষিত দ্রুত গতির বাসের আলাদা লেন (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি) প্রকল্পের গতি নেই। বলতে গেলে অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্প। প্রায় ছয় বছরেও প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু সম্ভব হচ্ছে না। দায়িত্বশীলরা বলছেন, প্রায় চার বছর আগে সমীক্ষার কাজ শেষ হলেও অর্থের সংস্থান হয়নি। এজন্য কাজ শুরুতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে ৪০ কিলোমিটার এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রাজধানীর প্রায় ২০ লাখ মানুষ সেবার আওতায় আসবে। এজন্য প্রয়োজন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৪০ মিনিটে গাজীপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত আসা সম্ভব হবে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। এশিয়ার ১০টি দেশের ৩৭টি সিটিতে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানিকে এই প্রকল্পে বাস পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফারুক জলিল জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের এলজিইডি অংশের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একটু সময় লাগলেও আশা করি মূলক কাজ শুরু হবে। এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবেই চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। এদিকে নগর বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। একদিকে ভূমি অধিগ্রহণ। আর্থিক সংস্থান। অন্যদিকে বিআরটি মধ্য দিয়ে সড়কে সকল রুটের বাস চলাচল নিশ্চিত করা যাবে না। রাস্তা প্রশস্ত না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে অন্যান্য পরিবহন চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। সবশেষে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো আছেই। তবুও তারা বলছেন, চ্যালেঞ্জ অনেক থাকলেও জনবহুল এই নগরীর মানুষের চলাচলে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে যে কোন মূল্যে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ততা। কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে আছে। তাছাড়া বিআরটির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই রাজধানীর যানজট নিরসন হবে না। প্রকল্পটি ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরামর্শ নগর বিশেষজ্ঞদের। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পবিদ ড. নুরুল ইসলাম নাজেম জনকণ্ঠকে বলেন, গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। এটা সত্য ও বাস্তব। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যানজট নিরসনে বিআরটি প্রকল্পটি আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত এই রুট সম্প্রসারণ করা গেলে সুফল মিলবে। সম্ভব হলে এই প্রকল্পটি ময়মনসিংহ-নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাসমূহ পর্যন্ত নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান নক্সা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাময়িক কিছু সুবিধা বাড়বে। সিমিত আকারে হলেও সর্বোপরি কিছু র‌্যাপিড ট্রানজিটের ব্যবস্থা হবে। ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলাকায় রাস্তা না বাড়ালে যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনার অভাবে ঢাকার চার ভাগের মধ্যে এক ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু নিউইয়র্কে ছোট রাস্তা হলেও ওয়ানওয়ে করা আছে। সেখানে ব্যবস্থাপনা ভাল থাকায় চলাচলে সমস্যা নেই। আমাদের দেশের রাস্তা দখলমুক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে কোন সমস্যা হবে না বলেও মনে করেন তিনি। তবে যথাসময়ে কাজ শেষ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের। রাজধানীর যানজট নিরসনে গাজীপুরের শিববাড়ি থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এই রুট দিয়ে গাজীপুর থেকে সদরঘাট হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প পর্যন্ত অল্প সময়ে পৌঁছানো যাবে। নির্ধারিত লেনে বিআরটির ১৮ মি. দৈর্ঘ্যরে আর্টিকুলেটেড বাসে ২৩ কিলোমিটার বেগে চলা উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। রাজধানীর যানজট সমস্যা সমাধানে স্ট্রেটেজিট ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) প্রণয়ন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এই পরিকল্পনায় ২০০৫ সালে তিনটি মেট্রো রেল ও তিনটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। রাজনৈতিক বাস্তবতা, আর্থিক যোগান না হওয়া, সরকারের আন্তরিকতার অভাবসহ নানা কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিক এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেনি। ফলে অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থাগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো করে রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তবে, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, মূল সড়কের মধ্যে একটি পৃথক লেনে গণপরিবহন (বাস) চলাচল করবে। সাধারণ পরিবহন চলাচল করবে পৃথক লেন ধরে। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও দ্রুত চলাচল নিশ্চিত করতে আন্ডারপান, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ ইন্টারসেকশনগুলোতে নেয়া হচ্ছে বিশেষ পদক্ষেপ। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নগরীতে যানজট কমবে। পরিবহন সেক্টরে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা। সময় বাঁচবে। নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত হবে। পরিবেশ উন্নতসহ যাত্রীদের বাসে ওঠা সহজ হবে। বিশ্বের জনবহুল বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ২০ কিলোমিটার করে পুরো প্রকল্পটি দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত অপরটি এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও প্রথমবারের মতো মানসম্মত পরিবহন সেবা নিয়ে এ প্রকল্প চালু করা হবে। বিআরটির মাধ্যমে গণপরিবহনের জন্য আলাদা সংরক্ষিত লেন থাকবে। ব্যয় হবে দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রতি দুই মিনিট পর পর বাস আসবে। ডিটিসিএ’র নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কায়কোবাদ হোসেন বলেন, গেল বছরের জুলাই মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন-এসটিপিতে সুপারিশ ছাড়া নগরীতে কোন উন্নয়ন প্রকল্পে বাস্তবায়ন করা যাবে না। অন্য কোন সংস্থা করতে চাইলে ডিটিসিএ’র অনুমোদন লাগবে। বিআরটি হলো এসটিপির মেগা প্রকল্পের একটি। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে এক সময়ে ঢাকা শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জরুরী বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, রাজধানীতে পায়ে হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যা ১৯ দশমিক সাত ভাগ, রিক্সায় ৩৮ দশমিক ৯, পাবলিক বাসে ২৮ দশমিক ৩ ও প্রাইভেটকারে চলা মানুষের সংখ্যা ৪ দশমিক নয় ভাগ। বিআরটি প্রকল্প আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর হতে কন্ট্রোল রুম থেকে বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তিনি জানান, মহাখালী বাস টার্মিনালকে তিন তলা করা হবে। এর মধ্যে মিনিবাসগুলো নিচে থাকবে। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বিআরটি বাস ও তৃতীয় তলায় থাকবে আন্তঃজেলা বাসগুলো। বিশাল এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়গুলোর মধ্যে রয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নগর উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত ২১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়, রাস্তা প্রশস্তকরণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা প্রভৃতি। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর হোটেল সোনারগাঁও অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে এই প্রকল্পের কাজ একই বছরের নবেম্বর মাসে শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলেও মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের কথা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট স্টাডির (ডিএইচইউটিএস) মতে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতিদিন ব্যক্তিগত যাতায়াত ট্রিপের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ। আর এ ট্রিপের সংখ্যা প্রতিবছর ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি লাইন-৩-এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সমীক্ষার কাজ শেষ হয়। সর্বশেষ প্রকল্পের রুটের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
×