ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম নজরুল ইসলাম

‘ধন্য সেই পুরুষ ...’

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৭ মার্চ ২০১৫

‘ধন্য সেই পুরুষ ...’

আজ ১৭ মার্চ, সেই মহান বাঙালীর জন্মদিন, যিনি বাঙালীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বাঙালীর ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন ৭ মার্চ, যেদিন রচিত হয়েছিল রাজনীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বসন্তের পাতাঝরা সেই দিনটি আর দশটি দিনের চেয়ে আলাদা ছিল। ছিল অন্যরকম। একটি পাতাঝরা বসন্ত বিকেল বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের মোড়। একজন মানুষ দিনে দিনে নিজেকে চালকের আসনে এনে একটি আন্দোলনকে জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত করতে পারেন এমন উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল তার তুলনা নেই। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে বিশ্বের বিখ্যাত ভাষণগুলোর পাশাপাশি তুলনা করা হয়েছে গ্যাটিসবার্গ এ্যাড্রেসের সঙ্গে। ৭ মার্চের বক্তৃতার ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এক দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেতার পরিচয়। ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বসেরার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার মধ্য দিয়েই কার্যত স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাদায়ী আলোচিত ওই ভাষণ নিয়ে লেখা হয়েছে কবিতাও। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণকে বিশ্বসেরা অন্যতম ভাষণ বলে মনে করেন অনেকে। বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে যুক্তরাজ্যের একটি প্রকাশনায় এই ভাষণটি স্থান পেয়েছে। ইংরেজীতে অনূদিত ভাষণের বইটির নাম ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি’। বইটির সঙ্কলক - জ্যাকব এফ ফিল্ড। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সেরা ভাষণ নিয়ে ২২৩ পৃষ্ঠার বই এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ থেকে নেয়া শিরোনামের এই সঙ্কলন গ্রন্থের শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ‘টিয়ারস ডাউন ওয়াল’। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ ট্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। পোয়েট অব পলিটিক্স, আমাদের স্বাধীনতার মহাকাব্যের রচয়িতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। গ্রামবাংলার সবুজ-শ্যামল ও নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি ও সমাজসচেতন। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। শৈশবেই পাওয়া যায় তাঁর নেতৃত্বের পরিচয়। তিনি স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। কৈশোরেই বঙ্গবন্ধুর কারাবাস শুরু। টুঙ্গিপাড়ার খোকা, যিনি পরে পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমান নামে, তারও পরে তিনি কেবলই বঙ্গবন্ধু। বাঙালীর জাতিসত্তার ইতিহাসের সমান্তরালে উচ্চারিত তাঁর নাম। টুঙ্গিপাড়ার খোকাকে শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম। বাঙালীর ওপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের খড়গ রুখতে তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নবগঠিত এই আওয়ামী লীগের নামকরণে প্রথমবারের মতো আঁতকে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ষাটের দশকের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ফলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। তবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালীর এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। সব আয়োজন শেষ। আর অপেক্ষা নয়। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী হিংস্র হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শুরু হয় তাঁর গোপন বিচার। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা। আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জন এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই সংগ্রামে তিনি ছিলেন নেতা। তাঁর নামে পরিচালিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার প্রধান সংগঠক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদাতা। জাতির আত্মপরিচয় এনে দিয়েছিলেন বলেই জাতির পিতা। তাঁকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর রৌদ্র ঝরে/ চিরকাল গান হয়ে/ নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা/ যার নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/ ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী এই মহান পুরুষকে জাতি আজ স্মরণ করছে বিনম্র শ্রদ্ধায়। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×