ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সালাহউদ্দিন নিখোঁজ কি রহস্যোপন্যাস হতে চলেছে?

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৭ মার্চ ২০১৫

সালাহউদ্দিন নিখোঁজ কি রহস্যোপন্যাস হতে চলেছে?

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজের বিষয়টি রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। নানা প্রশ্ন উঠছে। সত্যিই তিনি নিখোঁজ, নাকি আত্মগোপনে, না বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর মতো বিদেশে পলাতক, না চালকসহ ইলিয়াস আলী, ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম বা যুবলীগ নেতা লিয়াকত আলীর মতো হদিসহীন হয়ে পড়েছেন এসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এছাড়াও কোন গোষ্ঠী ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে অথবা রাষ্ট্র বা সরকারকে দেশ বিদেশে কূটনৈতিকভাবে বিপাকে ফেলতে বা রাজনৈতিক মাঠ গরম করতে পরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে কিনাÑ প্রশ্ন উঠেছে সেসব বিষয় নিয়েও। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সালাহউদ্দিনের হদিস করতে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে সালাহউদ্দিনের খুঁজে না পাওয়াটা রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আগামী ৮ এপ্রিল নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদের বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে হাইকোর্ট। সালাহউদ্দিন নিখোঁজের প্রতিবাদে সোমবার সারাদেশে বিক্ষোভ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে মহাসমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। এমন কর্মসূচীর ডাক দিলেও নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। কর্মসূচীর আড়ালে সারাদেশে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা হতে থাকে। টানা অবরোধের মধ্যেই অজ্ঞাত স্থান থেকে নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী সফল করার জন্য বিবৃতি আসছিল। চলমান অবরোধ-হরতালে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে। এছাড়া কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষকে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। ভাংচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অন্তত দুই হাজার যানবাহন। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও অজ্ঞাত স্থান থেকে নিখোঁজ সালাহ উদ্দিন আহমেদের নামে অবরোধ-হরতাল সফল করার ধারাবাহিক বিবৃতি আসছিল। নেতাকর্মীরা মাঠে না থেকে আত্মগোপনে চলে যান। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশেই আত্মগোপনে থেকে কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন। গত ১১ মার্চ সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ দাবি করেন, ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে তার স্বামীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন দাবি ভিত্তিহীন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়। সর্বশেষ গত ১২ মার্চ হাসিনা আহমেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সালাহউদ্দিনকে কেন খুঁজে বের করে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হবে না- সরকারকে তা গত রবিবারের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছিল। রবিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে সালাহউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি মর্মে ৫টি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় এ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরে। এরপর থেকেই সালাহউদ্দিনের নিখোঁজের বিষয়টি টক অব দি কান্ট্রিতে পরিণত হয়। শুরু হয় নানা আলোচনা সমালোচনা। এর মধ্যে সোমবার বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ্র চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলের শুনানি আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেন। এরআগে শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম র‌্যাবের তরফ থেকে দেয়া আরেকটি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধানে সারাদেশে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলছে। এদিকে সালাহ উদ্দিন আহমেদের হদিস না হওয়ায় রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সোমবার দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নৌকা সমর্থকগোষ্ঠী আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, আমরা কোন অজানা পথে চলছি, আমরা নিজেরাই জানি না। রাজনীতি হবে জনসমর্থনে, জনগণকে নিয়ে প্রকাশ্যে। অন্তরালের রাজনীতি অন্তর্ধানে পরিণত হয়েছে। এই রাজনীতি যদি অন্তর্ঘাতে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে সহিংসতা উস্কে দিয়েছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামী হাবিব হাসনাত নামের একজন কর্মকর্তার উত্তরার বাড়িতে থাকছিলেন। সেখান থেকেই তিনি দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। ১১ মার্চ হাবিব হাসনাত আমাকে জানান, ১০ মার্চ রাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল আপনার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। তুলে নেয়ার সময় বাড়ির দুই নিরাপত্তাকর্মীকে আটকে রাখা হয়েছিল। বাড়ির সামনের দুইটি রাস্তায় দুইটি গাড়ি রেখে ব্যারিকেড দেয়া ছিল। আর বাড়ির সামনে অন্তত ৫টি গাড়ি ছিল। এরপর আমার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন খবর পেয়েই আমি থানায় চলে যাই। হাবিব হাসনাতের উচিত ছিল ঘটনার রাতেই আমাকে বিষয়টি জানানো। ঘটনার রাতেই আমাকে জানালে আমি রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হতাম। কিন্তু কি কারণে বাড়ির মালিক হাবিব হাসনাত ঘটনার রাতে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানাননি, তা আমি জানি না। দেরিতে জানানোর বিষয়ে হাবিব হাসনাতের সঙ্গে জানানোর কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়ার বিষয়ে অবশ্য হাসিনা আহমেদ তেমন কিছুই বলেননি। তিনি দেশবাসীর কাছে তার স্বামীর হদিস মেলার বিষয়ে দোয়া চেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে অজ্ঞাত স্থান থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদ অবরোধ-হরতাল সফল করতে বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন। এমন বিবৃতি পাঠানোর পরেও নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। দলের শীর্ষ নেতারা নিরাপদে আত্মগোপনে থেকে কর্মকা- চালানোর কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ জন্য নেতাকর্মীরা মাঠে নামছেন না। নেতাকর্মীরাও দলের শীর্ষ নেতাদের মতো আত্মগোপনে থেকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও কোন কোন জেলায় জামায়াত-শিবির এবং জঙ্গীদের দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলাসহ মারাত্মক নাশকতা চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে নিরাপদে থেকে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশে চরম ক্ষুব্ধ অধিকাংশ নেতাকর্মী এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রভাবশালী একটি অংশ। স্বেচ্ছায় দেশে আত্মগোপনে থেকে বা বিদেশ পালিয়ে গিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের ঘারে দোষ চাপিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করার কৌশলের অংশ হিসেবে নিখোঁজের ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীও সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা বিচিত্র নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে রাষ্ট্র ও সরকারকে বহির্বিশ্বের কাছে বেকায়দায় ফেলতেও দলীয় নির্দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বা কোন গোষ্ঠীও ঘটাতে পারে। এছাড়া অপহরণকারী বিশেষ কোন গোষ্ঠীও সালাহউদ্দিন নিখোঁজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন অপহৃত হয়। দীর্ঘ সময় পর তাঁর কঙ্কাল উদ্ধার হয় গহীন জঙ্গল থেকে। তদন্তে বিএনপির কতিপয় নেতার জামাল উদ্দিন অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর বিদেশ পালিয়ে যাওয়া নিয়েও নানা নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত হারিছ চৌধুরী বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। এমন ঘটনা ছাড়াও আজও হদিস মেলেনি ২০০৮ সালের ২৬ নবেম্বর ধানম-ির বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেনের। এছাড়া ২০১০ সালের ২৫ জুন বিএনপির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম ও ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল চালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর আজও হদিস মেলেনি। সর্বশেষ সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত তার হদিস মেলেনি। এ ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়েরকৃত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন থানাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এবং ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার ইকবাল হোসেন।
×