ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২৮তম সাক্ষী খলিল মল্লিকের জবানবন্দী

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ কসাই সিরাজ মুক্তিযোদ্ধা সুনীলসহ ৮ জনকে গুলিতে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৬ মার্চ ২০১৫

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ কসাই সিরাজ মুক্তিযোদ্ধা সুনীলসহ ৮ জনকে গুলিতে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের তিন রাজাকার কসাই হিসেবে পরিচিত শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার, খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ২৮তম সাক্ষী মল্লিক খলিলুর রহমান জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দী শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে আংশিক জেরা করেছেন। আজ ফের সাক্ষীকে অসমাপ্ত জেরা করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেছেন, আসামি সিরাজ মাস্টারসহ অন্যান্য রাজাকার বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে মুক্তিযোদ্ধা সুনীলসহ ৮ জনকে হত্যা করেছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সাক্ষীর জবানবন্দীতে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ সায়েদুর হক সুমন। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম মল্লিক খলিলুর রহমান। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৬৭ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম- সন্তোষপুর, থানা- রামপাল, জেলা- বাগেরহাট। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এবং প্রাইমারী স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ২৪/২৫ বছর। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমরা আমাদের এলাকায় সংগ্রাম কমিটির তৎপরতা অব্যাহত রাখলে আমাদের এলাকার জব্বার হালদার, যিনি বাগেরহাট মহকুমা রাজাকার কমান্ডার রজব আলীর আত্মীয় ছিলেন। তিনি আমাদের বলেন যে, তোমরা সংগ্রাম কমিটি গঠন করায় রজব আলী তোমাদের ওপর ক্ষিপ্ত। তোমাদের ওপর যে কোন সময় আক্রমণ হতে পারে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ট্রেনিং সমাপ্ত করে আমরা আমাদের এলাকায় ফিরে আসি। আমাদের এলাকায় কালীখার বাড়ির দিঘিরপাড়ে ক্যাপ্টেন আফজাল হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আমরা সেখানে যোগদান করি। সাক্ষী বলেন, ঐ ক্যাম্পে যোগদানের পর রাজাকার কমান্ডার রজব আলী এবং ডেপুটি কমান্ডার আসামি সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে একদল রাজাকার ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আমাদের সহকর্মী যোদ্ধা ইউসুফ মারা যায়। ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর আমরা সেখান থেকে চুলকাঠি শ্যামপুর হাইস্কুলে অবস্থান নেই। পরদিন ১৩ অক্টোবর আনুমানিক নয়টা দশটার দিকে পাকিস্তানী আর্মি ও সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে একদল রাজাকার ঐ স্কুলে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। সারাদিন উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। ঐ ঘটনায় ক্যাপ্টেন আফজাল ও মুক্তিযোদ্ধা সুনীল আহত হয়। সন্ধ্যা হয়ে এলে পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। এরপর রাতের বেলা সারাদিনের যুদ্ধে আমাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে এবং খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় ক্যাপ্টেন আফজাল আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সাময়িকভাবে যে যার মতো করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা যে যার মতো চলে গেলে আমি এবং মুক্তিযোদ্ধা মনি ভাই আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হই। চুলকাটি বাজারের কাছে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যায়। এবং আমরা বাজারের পাশে একটি খালি ঝোপের ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, সকাল আনুমানিক দশটার দিকে আমরা চুলকাটি বাজারের আশপাশের এলাকা হতে হৈচৈ শুনতে পাই। আমরা বুঝতে পারি যে, রাজাকাররা চুলকাঠি বাজারের আশপাশের এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে। রাজাকাররা চুলকাঠি বাজারের ৩০/৪০টি দোকান আগুর দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বেলা সাড়ে এগারোটা বারোটার দিকে আমরা ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে পাই যে, আসামি সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ৫০/৬০ রাজাকার ৭/৮ জনকে ঘনশ্যামপুর এলাকার দিক হতে ধরে বাজারের কাঠের পুলের কাছে নিয়ে আসে। ঐ আটক ব্যক্তিদের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধা সুনীলও ছিল। সেখানে আটককৃতদের আত্মীয় স্বাজন কান্নাকাটি করে আসামি সিরাজ মাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে তাদের প্রাণভিক্ষা চায়। কিন্তু আসামি সিরাজ মাস্টার ও অন্য রাজাকাররা তাদের লাথি মেরে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। এরপর আসামি সিরাজ মাস্টার ও তার সঙ্গীয় রাজাকাররা ঐ ৭/৮ জনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে তাদের লাশ খালে ফেলে দেয়। সন্ধ্যার পর রাজাকাররা ঘটনাস্থল থেকে চলে গেলে আমরা লুকানো অবস্থান থেকে বের হয়ে ঘটনাস্থলে আসি। এবং খালের পাশে কয়েকটি লাশ পড়ে থাকতে দেখি। উপস্থিত লোকজনের কাছে শুনি রাজাকাররা সন্তোষ কুমার দেবনাথ, রাখাল দেবনাথ, জগদীশ পাল, খোরশেদ মল্লিক, দুর্গাচরণ দাস, বিজয় দাস ও মুক্তিযোদ্ধা সুনীলকে মেরে ফেলেছে।
×