ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই যুবককে খুঁজছে ডিবি

অভিজিত হত্যা রহস্য ঘনীভূত ॥ সন্দেহের শীর্ষে বুয়েট শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৪ মার্চ ২০১৫

অভিজিত হত্যা রহস্য ঘনীভূত ॥ সন্দেহের শীর্ষে বুয়েট শিক্ষক

আজাদ সুলায়মান ॥ মুক্তমনা লেখক অভিজিত হত্যার রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তদন্তকারীদের নজর এখন বইমেলায় আয়োজিত একটি বৈঠকের ওপর। এখন সন্দেহের শীর্ষে রয়েছেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী নামের একজন বুয়েট শিক্ষক। ডিবির তদন্তকারীরা ওই বৈঠকে অংশ নেয়া দুই যুবককে খুঁজছে। তাদের ধরা গেলে এ হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হবে বলে ডিবির ধারণা। বইমেলায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত ওই বৈঠকে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা ও সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। নিহতের পিতা অধ্যাপক অজয় রায়েরও ঘোর সন্দেহ ওই বৈঠকের ওপর। এ সম্পর্কে ডিবির তদন্তকারীদের একজন জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, শুধু বইমেলার একটি বৈঠক নয়, অভিজিত সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসার পর কোথায় কোথায় কার সঙ্গে এ ধরনের বৈঠক ও যোগাযোগ করেছেন সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্তে ডিবি যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করলেও এখনও হামলায় অংশ নেয়া কোন খুনীকে আটক করা সম্ভব হয়নি। জানা যায়, বইমেলায় আয়োজিত রহস্যময় এই বৈঠক সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ অভিজিতের পিতা অধ্যাপক অজয় রায়। বৈঠকটি আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের শিক্ষক ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। বুয়েটে পড়াশোনা করা অভিজিত বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করতেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলার ভেতরে ওই বৈঠক বা আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে হামলার শিকার হন অভিজিত ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। হামলাকারীদের চাপাতির আঘাতে মারা যান মুক্তমনা ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা লেখক-ব্লগার অভিজিত। মাথায় জখম হওয়ার পাশাপাশি চাপাতির আঘাতে একটি আঙুল হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন ব্লগার বন্যা। তারা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জঙ্গীবাদীদের হুমকির পরও বইমেলার টানে বাংলাদেশে এসেছিলেন অভিজিত। এবারের একুশের বইমেলায় তাঁর দুটি বই প্রকাশ উপলক্ষে। ওই বৈঠক সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বৈঠকেই দুজন অপরিচিত অতিথি বার বার অভিজিতকে অনেক উস্কানিমূলক প্রশ্ন করেন। কবে এসেছেন কবে ফিরে যাবেন কোন এয়ারলাইন্সের টিকেট কেটেছেন, আগামীতে কি ধরনের বই নিয়ে মেলায় ফিরবেন, জঙ্গীবাদ সম্পর্কে অভিজিত দম্পতির ধারণা কি- এ জাতীয় প্রশ্ন ওই বৈঠকে উচ্চারিত হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সেদিনের ওই বৈঠকে কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথির অংশ না নেয়ার বিষয়টিও অভিজিতের স্ত্রী বন্যার মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অজয় রায়। এমনকি অভিজিতকে হত্যার পর অজয় রায় বেশ কবার ফারসীমের মোবাইলে ফোন করেন। কিন্তু বার বারই সেটা বন্ধ পান। যদিও সাংবাদিকদের কাছে ফারসীম দাবি করেছেন, ওই আড্ডায় থাকা ব্যক্তিদের অধিকাংশ তার এবং অভিজিতেরও পরিচিত। অভিজিতের সঙ্গে কথা বলেই ওই বৈঠক আয়োজন করা হয়। এদিকে সেদিনের ওই বৈঠক সম্পর্কে শুক্রবার একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে অজয় রায় বলেন, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী নামে বুয়েটের ওই শিক্ষক সেদিন তাদের (অভিজিত-বন্যা) একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ডাকে। হামলায় আহত পুত্রবধূ বন্যার কাছে বিষয়টি জেনেছেন অজয় রায়। তিনি নিজের ডায়েরিতে সেদিনের পৃষ্ঠায় লিখে রাখা ফারসীমের নাম ও ফোন নম্ব^রটিও দেখান। অজয় রায় আরও জানান, বুয়েট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো অভিজিত লেখালেখির কারণে ফেসবুকে শফিউর রহমান ফারাবীসহ বিভিন্ন জনের হুমকি পাওয়ায় ছেলে দেশে ফেরার পর তাকে নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন তিনি। কিন্তু এ ধরনের হুমকির পর অভিজিত সত্যি সত্যিই খুন হয়ে যাবেন এমন ধারণা করতে পরেননি। এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বৈঠকের আগে পরে ফারসীমের ভূমিকা বেশ বিতর্কিত ও সন্দেহজনক। ফারসীম বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা নিয়ে কিছু তরুণের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ বৈঠকের নামে এটার আয়োজন করেন। সেখানে অংশ নেয়ার কথা ছিল আসিফ আর নিত্য নামে অভিজিত-বন্যার দুজনের পরিচিত লোক। কিন্তু তারা তো আসেইনি। বরং ওই আলোচনায় অভিজিতের অপরিচিত কিছু ছেলেপেলে ছিল। যাদের দেখে অভিজিত দম্পতি কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করেন। শুদ্ধস্বরের একটি অনুষ্ঠান থেকে সন্ধ্যা ৭টায় ফারসীম আয়োজিত ওই বৈঠকে গিয়েছিলেন অভিজিত ও বন্যা। অজয় রায় ওই বৈঠকে অংশ নেয়া অপরিচিত দুজনকে সন্দেহ করছেন এখন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, ফারসীম খুব ইনোসেন্টলি কাজটা করেছে। ও যে এটার মধ্যে ইনভলবড, তা না। কিন্তু সে অনেক লোকজন ডেকেছে, অনেকে এসেছে শুনে। এই যে আননোন কতগুলো ছেলে বসে আছে ওখানে। তারপর করল কী, ফারসীম ওর সঙ্গে আলোচনা-টালোচনা করে ওরা অভিজিতকে এসকর্ট করে যেখানে স্পটটা (হত্যা) হয়েছে ওই গেট দিয়ে বেরিয়েছে। ওই সময় ওই অপরিচিত ছেলে দুটো অভিজিতকে চা খাবার আমন্ত্রণ জানায়। ততক্ষণে ফারসীম নিজের কাজে চলে গেছে। তখন অভিজিত-বন্যার সঙ্গে অপরিচিত ওই যুবকরা ছাড়া পরিচিত আর কেউ ছিল না বলে বন্যার কাছে জেনেছেন অজয় রায়। তিনি আরও বলেন, আসিফ ওই বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলেন বলে অভিজিতকে বলা হয়েছিল। পরে বন্যা হাসপাতালে আসিফকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সেদিন অভিজিত ও বন্যা চা খায়নি। গোয়েন্দা তদন্তকারীরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হতে পেরেছে-অভিজিতের ওপর হামলাকারী ছিল দুজন। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও আহত হন বন্যা। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তা ফেলে দিয়ে দুই হামলাকারী দুই দিকে চলে যায়। হামলার আগে ওই ঘটনাস্থলের পাশেই দুজন দাঁড়িয়েছিল। তখন সেখানকার এক দোকানদার তাদের চা খেতে বলেন। উত্তরে যুবকদ্বয় বলেছেন- কাজটা করেই চা আমরা খাব। ওই যুবকদের বয়স ২৫/২৬ বছর হবে। উচ্চতা অভিজিতের মতোই। বেশ সুঠাম দেহ তাদের। এসব অভিযোগ ও সন্দেহ সম্পর্কে ফারসীম মান্নান একটি অনলাইন মাধ্যমকে বলেন, সেদিন যে ৭-৮ জন ছিলেন, তাদের দুজন বাদে আর সবাই তার চেনা। দাদাও তো (অভিজিত রায়) চিনতেন এদের সবাইকে। আর দাদার সঙ্গে কথা বলেই আমি ফেসবুকে ইভেন্ট দিয়েছিলাম। এটা তো সবাই জানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টলের কাছে ওই আড্ডায় অচেনা কারও থাকার সম্ভাবনা হাইলি আনলাইকলি। কারণ সেখানে ছিলেন বুয়েটের সাবেক ছাত্র ও বিজ্ঞান সাময়িকী ‘জিরো টু ইনফিনিটি’র সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, লেখক আব্দুল গাফফার রনি, হিমাংশু কর, সালিম অর্ণব, ফারহানা মান্নান, অনু তারেক। তবে আব্দুল গাফফার রনির সঙ্গে দুজন ছিল, যাদের একজন মধ্যবয়সী, কেবল এদেরই আমি চিনি না। বাকিদের বলতে পারি আমি চিনি। বিজ্ঞান লেখকদের বই প্রকাশ উপলক্ষে ওই আড্ডার আয়োজন হয়। আর দাদা (অভিজিত) তো ২০১২ সালেও বিজ্ঞান আড্ডায় এসেছিলেন, এই বইমেলার সময়ই। আসিফের না আসার বিষয়ে ফারসীম বলেন, উনি তো ইনভাইটেড ছিলেন। এখন কেন আসেন নাই, তা তো জানি না। আর নিত্য কে, তা আমি জানি না। এদিকে সর্বশেষ জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার সমস্ত আলামত ঢাকায় সফররত এফবিআইয়ের টিমের কাছে হস্তান্তর করার পর ডিবি নতুন আঙ্গিকে তদন্ত শুরু করেছে। যদিও বার বারই ডিবি দাবি করছে- এই মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ফারাবীর কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। হামলায় অংশ নেয়া খুনীদের চিহ্নিত করা গেলেও এখনও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
×