ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

বজ্র থেকে আওয়াজ কেড়ে নিয়ে

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১১ মার্চ ২০১৫

বজ্র থেকে আওয়াজ কেড়ে নিয়ে

আমরা এখন রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত। রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের কেন্দ্রে মানুষী সমস্যা, বিশেষ করে মানুষী স্মারক ও মূল্যবোধ। ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে আমাদের স্থায়ী ঘৃণা কি তৈরি হয়েছে? হয়নি, অথচ মানুষকে বুঝতে গেলে ভায়োলেন্সকে বাদ দেয়া যায় না। আমরা কি তারেকের দিক থেকে ভায়োলেন্সকে প্রত্যাখ্যান করব? আমাদের প্রিয় আদর্শ ও বিশ্বাস, আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে ধারণার একটা বড় অংশ এখানেই। ভায়োলেন্স, আমরা যদি প্লুরালিজম মানি, আমরা দেখি আমাদের জীবন যাপনের অনেক কিছুই ভায়োলেন্সের কাছে নত হয়ে আছে। আমরা ভয় পাই : বোমা বন্দুক ধারালো অস্ত্রকে ভয় পাই। কিন্তু আমরা তো মুক্ত সৃষ্টিশীল আত্মসমালোচনাপ্রিয় মানুষ। আমাদের অন্বিষ্ট তো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অন্বেষণ মানুষ হিসেবে আমাদের যে কোন অপ্রেসিভ ডিকটেটরশিপের বিরুদ্ধে লড়াকু করে রাখে। আমরা আমেরিকান বিপ্লব করেছি, ফরাসী বিপ্লব করেছি, রুশ বিপ্লব করেছি, চীনা বিপ্লব করেছি, আর আমরা বাংলাদেশে বিপ্লব করেছি। এখানেই মানুষ হিসেবে আমাদের মৌলিকত্ব। আমরা পরাজিত হইনি এবং সর্বত্র সর্বনাশের ভিতর আমরা জয়ী হয়েছি। জয়ের দিকে অগ্রসর হওয়াই শেষ পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য এবং লড়াই। বাংলাদেশে ধর্মজ নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে (মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তার প্রমাণ)। নৈতিকতা ও রাজনীতির মধ্যকার প্রভেদ উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানুষ খুন করা কি নৈতিক কাজ? মানুষ খুন করা কি রাজনীতির বিষয়? এ দুটি প্রশ্ন পরস্পরবিরোধী আবার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। জামায়াতে ইসলাম এবং বিএনপি এ দুটি কাজকে একত্র করেছে। মানুষ খুন করা যেমন তার রাজনীতির বিষয়, মানুষ অগ্নিদগ্ধ করা যেমন তার রাজনীতির স্ট্র্যাটেজি, গরিবকে প্রলুব্ধ করা যেমন তার ক্যাডার তৈরির মালমসলা; তেমনি এসব একত্র করা থেকে তৈরি হয় তার রাজনীতি। জামায়াত এবং বিএনপি এভাবে খুনী তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের-পূর্ব থেকে, মুক্তিযুদ্ধের কালে এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জামায়াত এবং বিএনপি এ দুটি স্ট্র্যাটেজি একত্র করে মানুষ খুন করেছে, তার বিরোধীকে হত্যা করেছে : এখান থেকে পিছপা হয়নি। জামায়াত এবং বিএনপি এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ খুন করা শুরু করেছে। মানুষকে খুন করা, আগুনে পোড়ানো, এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। একে কি রাজনীতি বলব? একে কি কোন অর্থে রাজনীতি বলা যায়? এর সঙ্গে যুক্ত আর একটি বিষয়। সে হচ্ছে রাজনীতিকে বিকিকিনির বিষয় করা। যারা তাদের রাজনীতির বিরোধী, টাকা দিয়ে তাদের কেনা। এভাবে টাকা-পয়সা রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক প্র্যাকটিসে পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতের মতো মালদার রাজনৈতিক দল আর একটিও নেই। নবীজীর সময়ে কোরাইশ বংশ টাকা দিয়ে মুসলমানদের কেনার চেষ্টা করেছে। বর্তমানকালে জামায়াত (এবং বিএনপি) কোরাইশ বংশের মতো টাকা দিয়ে বিরোধীদের (ইহুদীদের মতো) কেনার চেষ্টা করছে। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ও মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের টাকা দিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে (এমনকি বেহেশতের লোভ দেখিয়ে), সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে (মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাবার কথা বলে)। সেজন্য জামায়াত যেমন রাজনৈতিক তত্ত্ব নয় (খালেদা জিয়ার মধ্যে কি রাজনৈতিক তত্ত্ব আছে?), তেমনি জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক প্র্যাকটিস (নব্য নাৎসিবাদ)। খুন প্রমোট করে সামাজিক সলিডারিটি প্রমোট করা যায় না। এখানেই জামায়াতের (এবং বিএনপির) ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। দল হিসেবে জামায়াত যাদের বিভিন্ন বেনিফিট দিয়েছে (তরুণ আইনজীবী ব্যারিস্টার সাহেবরা, তারা বিলাত ফেরত, ডিগ্রীধারী) তারা খুনের সাফাই দিচ্ছে পৃথিবীতে যারা বিভিন্ন সময়ে খুন করেছে তাদের উদাহরণ দিয়ে। খুুনের পক্ষে যারা যুক্তি দেয় বাংলাদেশের যে অধ্যায় খুনস্নাত, সেই অধ্যায়কে গৌরবদীপ্ত করতে চায়, তারা কি মানুষ? তাদের মানুষ বলা সম্ভব না। বাংলাদেশে একজন ব্যারিস্টার, একজন আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি বজ্র থেকে আওয়াজ কেড়ে নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র শোনাবেন : আমি খুনীদের পক্ষে আইন ব্যবহার করি না। আইনের অর্থ : মনুষ্যত্ব সমুন্নত রাখা। মনুষ্যত্ব নস্যাত করে আইনজীবী হওয়া কি যায়? যায় না। যাওয়া উচিত নয়। খবরের কাগজে রোজ যখন বিচারের কথা পড়ি, তখন বিষাদে, দুঃখে, ক্ষোভে হৃদয় মন মনন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আমরা কবে, কখন মানুষ হব? মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াতে শিখব? খুনীদের ঘৃণা করতে শিখব? হত্যা করা কখনও কোন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ হতে পারে না।
×