ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে অর্থমন্ত্রী

অবরোধ হরতালেও সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৯ মার্চ ২০১৫

অবরোধ হরতালেও সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী

সংসদ রিপোর্টার ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা অবরোধ-হরতাল সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী রয়েছে। রাজস্ব আদায়, রফতানি আয় ও রেমিটেন্স বেড়েছে, কমেছে সরকারী ব্যয় ও মূল্যস্ফীতিও। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নও বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ; তবে আমদানি ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রক্ষেপণে খানিকটা পরিবর্তন আনা দরকার হতে পারে। তবে তেলের মূল্যের নিম্নমুখী প্রবণতার প্রভাবে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থান বজায় থাকবে। রবিবার জাতীয় সংসদে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটের দ্বিতীয় প্রান্তিক (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে এ তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের কঠোর সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আর্থ-সামাজিক অর্জনের পথ ধরে দেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত তখন এ অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার অপচেষ্টা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার সরবরাহে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সঙ্কট। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দৈনন্দিন কাজের সুযোগবঞ্চিত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বিসহ অবস্থায় পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর আর শ্রমিক শ্রেণী। এ সাময়িক সঙ্কট আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত করলেও আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশবাসীর সাহসী প্রতিরোধে অচিরেই জনবিচ্ছিন্ন এ সকল কার্যকলাপের সমাপ্তি হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের চৌকসতায় আর দেশের আপামর জনগণের স্বস্পৃহ সম্পৃক্ততায় ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ণ একটি বছর সাবলীল ধারায় এগিয়ে যাচ্ছিল দেশের অর্থনীতি। উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি স্থিতিশীলভাবে কমে আসা মূল্যস্ফীতি জনজীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল। পণ্য ও সেবার উৎপাদন, রফতানি, আমদানি, প্রবাস আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণ, উন্নয়ন কার্যক্রম ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই গতিশীলতার সঞ্চার হচ্ছিল। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীগণের আস্থা তৈরি করেছিল প্রবৃদ্ধির উচ্চতর সোপানে আরোহণের অমিত সম্ভাবনা। এর প্রতিফলন ঘটিয়ে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণে উর্ধমুখী পরিবর্তন এনেছিল। অর্থমন্ত্রী বলেন, গভীর বেদনার বিষয় এই যে, দেশপ্রেম বিবর্জিত সাম্প্রতিক অনভিপ্রেত কর্মকা- সেই সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। জনগণের স্বাভাবিক জীবনধারাকে করছে ব্যাহত। তবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বারংবার বাধাগ্রস্ত হওয়া বাঙালী জাতির জন্য নতুন কিছু নয়। আমরা বিশ্বাস করি জনবিচ্ছিন্ন এ সঙ্কট দীর্ঘায়িত হবে না। দল-মত নির্বিশেষে সকলের মধ্যে দেশপ্রেম, সহনশীলতা আর শুভচিন্তার উন্মেষ এবং জনগণের সচেতন প্রতিরোধ সকল সঙ্কটের অবসান ঘটাবে। দেশের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘলালিত অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন বাস্তব রূপ নেবে অচিরেই। এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটে গত ৯ মাসের বাস্তবায়ন প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে আবারও দেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, গত বাজেটে দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহের উল্লেখযোগ্য অংশ আমরা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্বমেয়াদে প্রতিশ্রুত চলমান কার্যক্রমসমূহের পাশাপাশি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে গৃহীত হয়েছে নতুন কিছু কার্যক্রম। প্রতিশ্রুত কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এসব কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজেটের দ্বিতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত অগ্রগতি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন কর রাজস্ব আদায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট সরকারী ব্যয় ৭৬ হাজার ৮৫৪ কোটি হতে দশমিক এক শতাংশ কমে হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের ১৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা হতে ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৯ কোটি টাকা। এছাড়া একই সময়ে রফতানি আয় বিগত অর্থছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের ১৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তিনি জানান, দ্বিতীয় প্রান্তিকে আমদানি ব্যয় ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ২২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমেÑ ১৩ দশমিক ২ এবং ১০ দশমিক ১ শতাংশ। প্রবাস আয় ১০ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিগত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাস আয় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তিনি জানান, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বর ২০১৩ সালের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হতে ডিসেম্বর ২০১৪ সময়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। কৃষিক্ষেত্রে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি সংগ্রহ, মজুদ ও সংরক্ষণের সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম আমরা নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি চাল রফতানি করতে সক্ষম হয়েছি। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনেও ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে সারাবিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। তিনি জানান, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছি, যা দারিদ্র্যের হার আরও কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত সরবরাহ সম্ভব হবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত ৮ হাজার ৩৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। লোডশেডিং যন্ত্রণা এখন আর নেই বললেই চলে। বিদ্যুত খাতে উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর। আমার বিশ্বাস, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে আমাদের নেয়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
×