ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৌলবাদী রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৯ মার্চ ২০১৫

মৌলবাদী রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সব মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিয়ে রবিবার পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৫। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে দিনটি পালন করেছে বিভিন্ন নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়ন, মানবতার উন্নয়ন’। রাজনীতিকে সহিংসতামুক্ত করে মানবিক করার জন্য রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ৬৮টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফরম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। পাশাপাশি নীতি নির্ধারণীর সব পর্যায়ে জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, হাইকোর্টের রায়ের আলোকে মৌলবাদী অপশক্তি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, ‘৭২-এর সংিবিধানের নীতিমালা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং জাতিসংঘের সিডও সনদের দুইটি ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহারসহ ১৪ দফা দাবি জানিয়েছে ওই কমিটি। রবিবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৫’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে ওই ৬৮ সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ আহ্বান ও দাবি জানান। তারা বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রয়োজন। তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সব ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে। আর এ জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে গড়ার ভাবধারায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী দল বরাবরই অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক দাবি তুলে নারীর অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অপশক্তিকে নির্মূল করতে না পারলে দেশে নারীর মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ সময় তারা রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে নারী, শিশুসহ, মানুষ হত্যা বন্ধ করে গণতান্ত্রিক কর্মসূচী পালনের জন্য রাজনীতিকদের আহ্বান জানান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিবার্হী পরিচালক ও সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন নারী মুক্তি সংসদের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হাজেরা সুলতানা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, দলিত নারী ফোরামের সভাপতি মণি রাণী দাস, হিলস উমেন ফেডারেশনের সভাপতি চঞ্চলা চাকমা, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের নেত্রী মহুয়া পাল, কর্মজীবী নারী প্রতিনিধি উম্মে হাসান ঝলমল, স্টেপসর নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারিক-উল ইসলাম বলেন, সরকার বিভিন্ন প্রতিকূল শক্তির বাধা উপেক্ষা করে নারী অধিকার সুরক্ষায় কাজ করছে। বর্তমানে রাজনীতির নামে পেট্রোলবোমা ছুড়ে গর্ভবতী মা ও শিশুকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এই বর্বরতার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় হতে পারে না। কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই নারীর প্রতি এ ধরনের বর্বরতার কথা ভাবা যায়। নারী, শিশুসহ নিরীহ মানুষের প্রতি এ বর্বরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দলিত, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সর্বস্তরের নারীর উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী প্রণয়ন করে। এ সব কর্মসূচীতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীর অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিডও সনদের সংরক্ষণ প্রত্যাহারের বিষয়টি সরকার চলমান রেখেছে বলেও জানান তিনি। সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, নারী এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নারীর অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অনেক চ্যালেঞ্জ। মৌলবাদ তার অন্যতম। নারী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে মৌলবাদী অপশক্তিকে রুখতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতি পরিহার করতে হবে। রাজনীতির তৃণমূল পর্যায় থেকে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী স্তর পর্যন্ত নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সংসদে নারী সংরক্ষিত আসনের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি। এর আগে বিকেল চারটায় নারীর অধিকার বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা । এরপর রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত মানুষের স্মরণে মিলনায়তনে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। পরে প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে দিলীপ কুমার সরকার ১৪ দফা দাবিনামা পড়ে শোনান। এদিকে, প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে দেশের বিভিন্ন উইমেন চেম্বার এবং উইমেন এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সভাপতি ও নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা হাকিম আলী, সহসভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মোঃ বজলুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, মোঃ মোতালেব, আনোয়ার হোসেন, নারী উদ্যোক্তা আনোয়ারা খানম পলি, প্রীতি চক্রবর্তী, আমিনা রহমান, ড. ফেরদৌসী বেগম, ইশমত জেরিন খান, জাকিয়া সুলতানা মিথিলা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে এফবিসিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অবদান অনেক বেড়েছে। বেসরকারী খাতে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে সর্বক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, নারীরা যে এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ দেশে নারী উদ্যোক্তা অনেক বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হলে স্বল্পসুদ ও জামানতবিহীন ঋণ দিতে হবে। নিজের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তৃণমূল থেকে উঠে এসে আজকে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি। আগামীতে সভাপতি পদে নির্বাচন অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। নারীরা যে এগিয়ে যাচ্ছে এটাই বাস্তব। বজলুর রহমান বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। এদেশে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করে সারাদেশ থেকে নারী উদ্যোক্তারা এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। নারী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মানববন্ধন, র‌্যালি ও সমাবেশের আয়োজন করে। সকাল সাড়ে ১০টায় ‘নারীর সার্বিক উন্নয়ন, চাই সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক দাবিতে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ (বিইউপি) ও গ্লোবাল কল টু এ্যাকশন এ্যাগেন্স্ট পোভার্টি (জিসিএপি)। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খালিকুজ্জমান আহমেদ এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি বলেন, কেবল অর্থ উপার্জনে অগ্রগামিতা নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। এ জন্য পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাকে যুক্ত করতে হবে। মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিইউপি নির্বাহী পরিচালক ড. নিলুফা বানু, বাউশির নির্বাহী পরিচালক মাহবুবা বেগম, জিসিএপির কো-অর্ডিনেটর আবদুল আউয়াল প্রমুখ। একই স্থানে মুশতারী বেগমের সভাপতিত্বে নারীর প্রতি সকল সহিংসতা বন্ধ করা, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকার নিশ্চিত করাসহ ১৬ দফা দাবিতে মানবন্ধন করেছে সাউথ এশিয়ান ওমেন্স ফোরাম (বাংলাদেশ চ্যাপ্টার)। মানববন্ধনের শুরুতে চলমান সহিংসতায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বক্তব্য রাখেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজা বেগম, লাভলী ইয়াসমীন, শামীমা শিরীন প্রমুখ। সংযুক্ত মহিলা পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নিপা ইসলাম, অর্থসম্পাদক শেফালী হোসেন, সহসভাপতি সীমা ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা বলেন, নারী-পুরুষের মানবাধিকার বাস্তবায়নে পৈত্রিক সম্পত্তিতে সমঅধিকার এবং জাতীয় সংসদে মহিলা আসন ৫০% নিশ্চিত করতে হবে। নারী শ্রমিকের সকল ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের স্বীকৃতি দাবি করে সমাবেশ ও র‌্যালি করেছে রেডিমেট গার্মেন্টস ওয়ার্কাস ফেডারেশন। সংগঠনের সভাপতি লাভলী ইয়াসমীনের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম। বক্তব্য রাখেন জাগো নারী ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নুরুন্নাহার মেরী, নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোঃ শামসুদ্দিন, ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি সুলতান বাহার প্রমুখ। সমতাভিত্তিক সমাজ ও দলিত নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবিতে যৌথভাবে মানববন্ধন করেছে দলিত নারী ফোরাম, বাংলাদেশ দলিত নারী ফেডারেশন ও নাগরিক উদ্যোগ। বক্তারা সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত দলিত নারীদের উন্নয়নে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
×