ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেগম জিয়া নিজেকে কেন আইনের উর্ধে মনে করেন?

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৮ মার্চ ২০১৫

বেগম জিয়া নিজেকে কেন আইনের উর্ধে মনে করেন?

কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে ডাকা বেগম জিয়ার দেশব্যাপী অবরোধের দু’মাস পার হলো। অপ্রত্যাশিত এই কারণেই বিএনপিপ্রধান গত ৫ জানুয়ারি অনেকটা অগ্নিমূর্তি নিয়ে নিজ অফিস হতে বিকেলে বের হয়ে তাঁর দলের ডাকা নয়াপল্টনের সমাবেশে পুলিরে বাধার কারণে যেতে ব্যর্থ হলেন। কিছু জাতীয়তাবাদী ঘরানার সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ম্যাডাম এর পর কী অবরোধ না হরতাল। তখন তিনি একটুও না ভেবে ঘোষণা করলেন, অবরোধ চলছে চলবে। অথচ এই দিন তাঁর দল বা জোটের কোন অবরোধ ছিল না। ছিল তাদের ভাষায় ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস উপলক্ষে তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা একটি সমাবেশ, যার অনুমতি প্রশাসন হতে পাওয়া যায়নি। কারণ একই দিন আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো সারাদেশে গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা দিবস ডেকেছিল। এই দিনে এক বছর পূর্বে ২০১৪ সালে দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল যা বিএনপি কিছু অসাংবিধানিক দাবি তুলে বর্জন করেছিল। বেগম জিয়া ঠিকই জানতেন নয়াপল্টনে কোন সমাবেশ হচ্ছে না। অনেকের প্রশ্ন আসলে তিনি কোথায় যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন? প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে যেতেন এবং সেখানেই তিনি অবস্থান করতেন যেমনটি বর্তমানে তাঁর দফতরে করছেন এবং এসব করে তিনি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতেন। একাধিক সাংবাদিকের সূত্রে জানা গেছে, এই মর্মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সকল ধরনের আয়োজনও করা হয়েছিল। বহুদিন ধরে প্রেসক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটি জামায়াত-বিএনপি ঘরানার সাংবাদিকদের দখলে। অনেকে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপির বিকল্প দফতর বলে মনে করেন। সম্ভবত গোয়েন্দা সূত্র এসব তথ্য আগে পেয়ে যাওয়ার কারণে বেগম জিয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাঁর ডাকা অবরোধের দু’মাস পার হলো গত ৫ তারিখ। এই অবরোধের মাঝখানে আবার শুরু হলো সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল ডাকার তামাশা। তামাশা এই কারণে যে, হরতাল এখন আর কেউ তেমন একটা পাত্তা দেয় না। ক্ষতি যা হচ্ছে তা হচ্ছে মূলত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার। পনের লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সময়মতো তাদের পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি। স্কুলের বাচ্চারা সপ্তাহের পাঁচ দিন ক্লাসে যেতে পারে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-নেত্রীদের কোন অসুবিধা নেই। কারণ তাদের বেশির ভাগেরই সন্তানরা এই দেশে পড়ালেখা করে না। বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কুয়ালালামপুরে হঠাৎ মৃত্যু হলে তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে স্ত্রী ও দুই মেয়ে দেশে আসে। কোকোর দাফন শেষ হলে দু’দিনের মাথায় মা-মেয়ে কুয়ালালামপুরে ফিরে যায়। কারণ বেগম জিয়ার দুই নাতনির পরীক্ষা। বুধবার কোকোর চেহলাম অনুষ্ঠিত হলো। তাঁর স্ত্রী বা সন্তানরা কেউ আসেনি। কারণ বাচ্চাদের পরীক্ষা। বেগম জিয়া তাঁর নাতনিদের পরীক্ষা নিয়ে বেশ যতœশীল। কিন্তু তিনি কি একবারও চিন্তা করেছেন তাঁর কারণে দেশের পনের লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সময়মতো তাদের পরীক্ষা দিতে পারেনি; এই বছর বাংলাদেশের হাজার হাজার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা হতে বঞ্চিত হয়ে এক বছর পিছিয়ে গেছে। বেগম জিয়া কি জানেন তাঁর অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অভিপ্রায়ের কারণে দেশে চার কোটি শিক্ষা ঘণ্টা প্রতিদিন নষ্ট হয়? সে দিন তাঁরই এক ডাকসাইটে নেতা, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন বিবিসি সংলাপে এক প্রশ্নকর্তার উত্তরে বললেন, কিসের কী পরীক্ষা? জাতি এখন অন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ব্যস্ত। এক সময় বিএনপি হতে স্বেচ্ছায় বের হয়ে যাওয়া কর্নেল অলি আহমদ বলেন, পরীক্ষা দু’মাস পিছিয়ে দিলে কোন ক্ষতি নেই। তিনি বর্তমানে বেগম জিয়ার ২০ দলীয় ঐক্যজোটের একজন জাঁদরেল সদস্য। বিএনপি হতে বের হয়ে তিনি বলেছিলেন, মা ভাল হলে সন্তানরাও ভাল হয়। মা-ছেলে তিনজনই বদমাশ। বেগম জিয়ার এককালের শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক নিউইয়র্কে এক দলীয় সভায় বলেছেন, এই মুহূর্তে কতজন মারা গেল আর অর্থনীতির কত ক্ষতি হলো তা হিসাব করার সময় নেই। এখন শেখ হাসিনাকে উৎখাত ‘আন্দোলন’ চলছে। এই হলো আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনা বিরোধীদের রাজনৈতিক অবস্থা। গত দুই মাসে বেগম জিয়ার ডাকা অবরোধ আর তার সঙ্গে হরতাল ছিল সম্পূর্ণভাবে ভয়াবহ সন্ত্রাস আর নাশকতানির্ভর। এই দু’মাসে পেট্রোলবোমার মতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র কেড়ে নিয়েছে ৬৬ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ। বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। অন্যান্য কারণে প্রাণ গেছে আরও ১৭ জনের। বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন কয়েকশত মানুষ। প্রায় দেড় হাজার যানবাহনে অগ্নিসংযোগ অথবা ভাঙচুর করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি এই মুহূর্তে সঠিকভাবে পরিমাপ করা অসম্ভব। এক অজ্ঞাত কারণে বেগম জিয়া নিজের বাসস্থান ছেড়ে তাঁর অফিসকে বাড়ি বানিয়েছেন। তাতে তেমন কোন অসুবিধা নেই। এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এমন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন। তবে বেগম জিয়ার অফিসের শানশওকত আর জেল্লা দেখে মনে হওয়ার কোন কারণ নেই, তিনি খুব অসুবিধায় আছেন। সেদিন দশজন বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গে যেই কক্ষে বসে তিনি কথা বললেন, সেই কক্ষে স্থাপিত স্যান্ডেলিয়ার আর কার্পেট সোফা দেখে মনে হবে এটি কোন একটি পাঁচতারকা হোটেলের ভিভিআইপি স্যুইটের ড্রইংরুম। এরই মধ্যে দুটি দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়া দীর্ঘদিন হাজির না হওয়াতে তাঁর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। ৬৩ বারের মধ্যে তিনি মাত্র সাতবার আদালতে হাজির হয়েছেন। যেদিন হাজিরার তারিখ থাকে সেদিন তাঁর আইনজীবীরা কোন একটা অজুহাত বের করেন অথবা ওই দিন মহানগর বিএনপি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করে। গত ৪ তারিখ বেগম জিয়ার আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা ছিল। এই হাজিরা নিয়ে আবার দেশে টান টান উত্তেজনা। কারণ অন্যকিছু নয়, এই সামান্য হাজিরাকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপির সম্ভাব্য নাশকতা। বেগম জিয়ার আইনজীবীরা একবার বলেন তিনি আদালতে হাজির হবেন না আবার দু-একজন বলেন তিনি হাজির হতে পারেন দুই শর্তে। প্রথমত তাঁকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে আর দ্বিতীয়ত তাঁকে আবার তাঁর অফিস-কাম রেসিডেন্সে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। শর্ত দিয়ে আদালতে হাজিরা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বেগম জিয়ার আরেক আইনজীবী বলেই বসলেন, শেখ হাসিনা যদি আদালতে না গিয়ে মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে বেগম জিয়া কেন পারবেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, বেগম জিয়া আর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দুটি সরকার করেনি দুদক করেছে এবং মোটামুটি হয়ত তাঁর আইনজীবীরা নিশ্চিত হয়ে গেছেন, বিদ্যমান আইনে বেগম জিয়া আর তারেক রহমানকে বিচারের সাজা থেকে রক্ষা করা সহজ হবে না। আর বেগম জিয়া কখনও আদালতে ব্যক্তিগত হাজিরা মওকুফ চেয়ে আবেদন করেননি যা তারেক রহমান করেছেন। অন্যদিকে গণমাধ্যমে খবর হচ্ছে, লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের পাসপোর্ট বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়াতে তিনি এখন সেখানে শরণার্থী স্ট্যাটাস নিয়ে আছেন। আবার অন্যদিকে কর ফাঁকি দেয়ার অন্য আরেক মামলাতেও তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। তবে আইন-আদালত, সংবিধান না মানা অনেকটা বেগম জিয়া ও তাঁর পরিবারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জিয়া সেনাপ্রধান থাকাকালে আইন ভঙ্গ করে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন করেছেন। সেনাবাহিনী থেকে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নিয়ে পেছনের তারিখ দিয়ে দু’মাস পর নিজেকে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়েছেন যা ছিল এক ধরনের জালিয়াতি। তাঁর আমলে কমপক্ষে কুড়িটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে। এই অপরাধে তিনি অনেকটা বিনা বিচারে আনুমানিক দু’হাজার সেনা সদস্যকে নির্মমভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কর্নেল তাহেরকে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ফাঁসি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। তাঁদের যাতে বিচার না হয় সেজন্য তিনি সংসদে ইন্ডেমনিটি আইন পাস করিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বেগম জিয়াও এই সংস্কৃতি বজায় রেখেছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদলে তিনি তাদের মন্ত্রী বানিয়েছেন। সুতরাং এমন একজন মহিলার কাছে আইনের প্রতি কোন ধরনের শ্রদ্ধা আশা করা একেবারেই বোকামি। সরকার সব সময় আইন নিজস্ব গতিতে চলবে বলে থাকে। কিন্তু বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটে। বেগম জিয়ার জন্য একরকমের আইন আর দেশের অন্য মানুষের জন্য অন্যরকমের আইন, তা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে বর্তমানে যে পেট্রোলবোমার সংস্কৃতি চলছে তার জন্য যারা দায়ী ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনে তাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-ই হওয়ার কথা আছে। এই আইনেই জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করা সম্ভব। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে কেন যে এই আইনটি কার্যকর করা হচ্ছে না তাও এক বড় প্রশ্ন। সেদিন এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক হাসতে হাসতে আমার কাছে প্রশ্ন করলেন, এই যে বিএনপির এক রহস্য পুরুষ সালাহউদ্দিন প্রতি শুক্রবার তাদের দাবি মানার হুমকি দিয়ে পরবর্তী সপ্তাহের ৩+২ দিনের হরতাল ডাকে, তা কতদিন চলবে? উত্তরে বলি, হয়ত ২০১৯ সাল পর্যন্ত। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, সবচেয়ে ভাল হয় একবারে ঘোষণা করে দেয়া ২০১৯ সাল পর্যন্ত হরতালের এই রকম কর্মসূচীই বহাল থাকবে। তবে অমুক অমুক দিন তা বন্ধ থাকবে। তেমনটা যদি হয় তাহলে আমরা আমাদের সকল কর্মসূচী সেভাবেই ঠিক করে নিতে পারি। সেই কূটনীতিককে বলি, এখন সালাহউদ্দিন বিএনপির ওসামা বিন লাদেন। তিনি তাঁর তোরা বোরা পর্বতের গুহা হতে প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার ফতোয়া দেন। কূটনীতিকের হাসি আর থামে না। দেশের মানুষের এখন বড় প্রশ্ন- বেগম জিয়া আর তাঁর হন্তারকরা আর কতদিন আইনের বাইরে থাকবেন! মার্চ ৭, ২০১৫। লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
×