ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুরন্ত সরফরাজে উড়ল পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৮ মার্চ ২০১৫

দুরন্ত সরফরাজে উড়ল পাকিস্তান

শাকিল আহমেদ মিরাজ ॥ প্রসারিত দু’হাতকে পাখির ডানা করে উড়তে চাইলেন মিসবাহ-উল হক। সম্প্রতি চল্লিশোর্ধ পাকিস্তান অধিনায়ককে এতটা উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে কমই দেখা গেছে। কিছুটা রাশভারী আর দার্শনিক স্বভাবের ক্রিকেটারটি বরাবর শান্ত এক মানুষ। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে সেই শান্ত মানুষটিই হয়ে উঠলেন অশান্ত, গোটা দল নিয়ে মাতলেন নির্মল এক আনন্দে। বৃষ্টিবিঘ্নিত নাটকীয় ম্যাচে কাল শক্তিধর দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২৯ রানে হারিয়ে মাতল গোটা পাকিস্তানই। পেশোয়ার থেকে করাচী বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়ল সাধারণ পা মানুষ। যেন বিশ্বকাপ জয় করে ফেলেছে তাঁরা! তিন জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে পুল ‘বি’এর তৃতীয় স্থানে উঠে আসা পাকিস্তানের শেষ আটের পথ আরও উজ্জ্বল হলো। অথচ টানা দুই হারে আসর শুরুর পর প্রতিটি ম্যাচই যেখানে নক-আউট, হারলেই পত্রপাঠ বিদায়, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারানোর মাহাত্ম্যই অন্যরকম। আবেগে ভাসলেও খোদ পাকিস্তানী ভক্তরাও হয়ত এতটা ভরসা পাচ্ছিলেন না। মিসবাহ, শহীদ আফ্রিদি, সরফরাজ আহমেদরা করে দেখালেন, দেখালেন ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ বলেই। দু’দফার বৃষ্টিতে প্রথমে ৪৭ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ২ বল বাকি থাকতেই অলআউট ২২২ রানে, এরপর হাশিম আমলা-এবি ডি ভিলিয়ার্সদের নিয়ে গড়া দুর্বার প্রোটিয়াদের ((টার্গেট ২৩২) ৩৩.৩ ওভারে ২০২ রানে গুটিয়ে দিয়ে ডার্কওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ২৯ রানের জয়; ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ নয় তো কী!! খেলা শুরু হওয়ার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দু’দফা বৃষ্টি। শেষ আটের আশা বাঁচিয়ে রাখতে জিতইে হবে, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে টসও হাসেনি পাকিদের হয়ে। প্রতিপক্ষ সেনাপতি এবি ডি ভিলিয়ার্স ফিল্ডিং বেছে নেয়ার পর মূল কাজটা ছিল পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের। প্রতিনিয়ত যারা সমালোচনার সম্মুখীন। ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বড় ব্যবধানে হার দিয়ে আসর শুরুর পর দুর্বল জিম্বাবুইয়ে ও আরব আমিরাতের বিপক্ষে জয় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। কোন ম্যাচেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি পাকিদের ব্যাটিং। তবে ইডেন পার্কের গতি আর বাউন্সি উইকেটে ডেল স্টেইন-কাইল এ্যাবটদের বিপক্ষে শুরুটা মন্দ ছিল না। দলীয় ৩০ ও ব্যক্তিগত ১৮ রানে সাজঘরে ফেরেন ইনফর্ম আহমেদ শেহজাদ। নাসির জামসেদের পরিবর্তে পাওয়া সুযোগটাকে দারুণভাবে কাজে লাগান সরফরাজ আহমেদ। দ্বিতীয় উইকেটে ইউনুস খানের সঙ্গে ৮ ওভারে মূল্যবান ৬২ রান যোগ করেন সরফরাজ। মাত্র ১ রানের জন্য হাফ সেঞ্চুরি পাননি। ৪৯ বলে ৫ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৯ রানের দর্শনীয় ইনিংস খেলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট হন তিনি। ইউনস-মিসবাহর ধৈর্যশীল ৪০ রানের জুটি বড় সংগ্রহের ইঙ্গিতই দিচ্ছিল। কিন্তু ৩৭ রান করে ‘অকেশনাল’ ডি ভিলিয়ার্সের শিকারে পরিণত হন ইউনুস! প্রোটিয়া পেস তা-বে এরপরই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং-লাইন। ১৩১/২ থেকে ১৭৫/৫! যথারীতি একপ্রান্ত আগলে রাখেন মিসবাহ। মাঝে শহীদ আফ্রিদির ১৫ বলে ১ চার ও ২ ছক্কায় ২২ রানের ঝড়ো ইনিংস, উমর আকমলের ১৩ উল্লেখ্য। মিসবাহর কথা আলাদা করে না বললেই নয়। চলতি বিশ্বকাপে টানা তৃতীয় ও ক্যারিয়ারের ৪২তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেয়া পাকিস্তান অধিনায়ক আউট হন ৫৬ রানে, ৮৬ বলে চার ৪টি। এর মধ্য দিয়ে ১২তম পাকিস্তানী ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন মিসবাহ। ১৬০ ম্যাচে মোট রান ৫,০৪৯। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৯৬। তার মানে কোন সেঞ্চুরি ছাড়াই ৪২টি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফেললেন ‘মিঃ হাফ সেঞ্চুরি’ মিসবাহ। সেঞ্চুরি বিহীন হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড এটি, ২৫ হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে তার কাছাকাছি সাবেক নিউজিল্যান্ড তারকা এ্যান্ড্রু জোন্স (১৯৮৭-১৯৯৫)! মূলত মিসবাহ ও সরফরাজের সৌজন্যে ২২২ রানের সম্মানজনক পুঁজি পায় পাকিস্তান। দ. আফ্রিকার হয়ে ডেল স্টেইন ৩টি, কাইল এ্যাবট ও মরনে মরকেল নেন ২টি করে উইকেট। যে দলে ডি ভিলিয়ার্স, আমলা, ফাফ ডুপ্লেসিস, রাইলি রুশো, ডেভিড মিলার, জেপি ডুমিনির মতো ভয়ঙ্কর সব ব্যাটসম্যান সেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই পুঁজি নিয়ে জয়টা অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য কাজটাকে বিশ্বাস্য করে পাকিস্তানী বোলার ও ফিল্ডাররা। রানের খাতা খোলার আগে প্রথম ওভারেই কুইন্টন ডি’কককে ফিরিয়ে দিয়ে শুরুটা করে মোহাম্মদ ইরফান। এরপর আমলা-ডুপ্লেসিস মিলে মাত্র ৯ ওভারে ৬৭ রানের জুটি গড়লে মনে হচ্ছিল অনায়াস জয় পাবে প্রোটিয়ারা। কিন্তু দলীয় ১১ ও ১৩তম ওভারে আমলা (২৯ বলে ২৭) ও রুশোকে (৯ বলে ৬) তুলে নিয়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেন ওয়াহাব রিয়াজ! এরপর ‘ওয়ানডের ডেঞ্জারম্যান’ ডেভিড মিলারকে রানের খাতাই খুলতে দেননি পেসার রাহাত আলি। ৬৭/২ থেকে সহসা ৭৭/৫-এর পরিণত হয় দ. আফ্রিকা! তবু ভয় ছিল। একপ্রান্তে নিজের স্টাইলে খেলে যাচ্ছিলেন ডি ভিলিয়ার্স। অপর প্রান্তে মহাসংগ্রাম চালিয়ে তাঁকে স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন লোয়ার-অর্ডারে স্টেইন-এ্যাবট-মরকেলরা। প্রয়োজনীয় রানও চলে আসে আয়ত্তের কাছাকাছি। দলীয় ঠিক ২০০ রানে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে (৫৮ বলে ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ৭৭ রান করা) ডি ভিলিয়ার্সকে ফেরান সোহেল খান, এরপর শেষ ব্যাটসম্যান ইমরান তাহিরকে তুলে নেন ওয়াহাব রিয়াজ। দক্ষিণ আফ্রিকা গুটিয়ে যায় ২০২ রানে। তখনই ২৯ রানের দুরন্ত জয়ে মিসবাহদের পাখি হয়ে ওড়া! ইরফান, রাহাত ও ওয়াহাব প্রত্যেকে নেন ৩টি করে উইকেট। এবারের বিশ্বকাপে তিন বাঁহাতি পেসার মিলে ৯ উইকেট শিকারের দ্বিতীয় ঘটনা এটি। ৪৯ রানের দারুণ ইনিংসের পর রেকর্ড ৬টি ক্যাচ নিয়ে ‘নায়ক’ বনে যান সরফরাজ। ইতিহাসে ৬ ক্যাচ যৌথভাবে সর্বোচ্চ। ওয়ানডেতে তার আগে এমন কীর্তি গড়েছেন সাত উইকেটরক্ষক। তবে এ্যাডাম গিলক্রিস্টের পর (২০০৩) দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে এমন নজির স্থাপন করলেন সরফরাজ। হলেন ম্যাচসেরা। যার কল্যাণে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের স্বাদ পেল পাকিরা অথচ আগের ম্যাচগুলোতে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে- এই না হলো ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ পাকিস্তান!
×