ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলনবিলে নারীর কাঁধে লাঙ্গল জোয়াল

বগুড়ায় নারীর হাতে ॥ সিএনজি অটোরিক্সার স্টিয়ারিং

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৮ মার্চ ২০১৫

বগুড়ায় নারীর হাতে ॥ সিএনজি অটোরিক্সার স্টিয়ারিং

সমুদ্র হক ॥ নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বলা হয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশ(!)। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের চিত্র প্রমাণ করে এই হার গড়ে ৬০ শতাংশেরও বেশি। বিশেষ করে কৃষি কাজের বড় অংশটি এখন পরিচালিত হয় নারীর মাধ্যমে। ফসল বোনা, চারা রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা পালার পর ফসল কেটে আঙিনায় তুলে মাড়াই ও সিদ্ধ শুকান এবং ভ্রাম্যমাণ কলে হোস্কিং চাল বের করে আনার কাজগুলোর একটা বড় অংশ এখন নারীই করছে। কৃষিতে নারীর এই অগ্রযাত্রায় সারা বছর নানা জাতের ধানের আবাদ তো হচ্ছেই সবজিসহ নানা জাতের আবাদ শুরু হয়েছে। সবজি রফতানি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এ বছর ধান রফতানিও শুরু হয়েছে। আরেক দিকে গার্মেন্ট শিল্প টিকিয়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ার বাড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের নারী। একটি সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৩ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। এই অর্জনে নারীর অবদান রয়েছে অনেক। বগুড়ার যমুনা তীরবর্তী সারিয়াকান্দিতে নারী সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালনা শিখে অটোরিক্সা নিয়ে মহাসড়কে নেমেছে। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা গাড়ি চালাচ্ছে। অটোমোবাইলের কাজ শিখে গাড়ি মেরামত করে দিচ্ছে। প্রতিটি সেক্টরেই এখন নারীর অগ্রগামী। হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে। উড়োজাহাজ চালাচ্ছে। বিচারক, শিক্ষক, সিভিল সার্ভিসের অফিসার, সেনা অফিসার, বিমান সেনা, নৌ সেনা, মিডিয়া, পুলিশসহ এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে নারী যে কত অবদান রেখেছে তার বড় প্রমাণ জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের নারী। ভাবা যায়! এদিকে দেশে নারী শিক্ষার হার কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে স্নাতক শ্রেণী (কলেজ পর্যায়) পর্যন্ত নারী শিক্ষা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা হোঁচট খেতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চতর (এমফিল পিএইচডি) পাঠ পর্যায়ে। তবে আশার কথা হলো নারীর উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার ইচ্ছাও বেড়ে যাচ্ছে। অনেক নারী চাকরির পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার লক্ষ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে নারী যত শিক্ষিত হচ্ছে বাল্যবিয়ের হার কমে যাচ্ছে। শিক্ষিত নারী কখনই বালিকা বধূ হতে রাজি নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলে নদী তীরের চর এলাকার অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে চাইলে শিক্ষিত মেয়েরা তার প্রতিবাদ করছে। অনেক ক্ষেত্রে এই শিক্ষিত মেয়েরা নিজেদের ডিফেন্ড করছে সাহসের সঙ্গে। দেশে শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) একটি সূত্রে বলা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে মেয়ে ও ছেলে শিশুর ভর্তির হার আধাআধি। কোথাও মেয়ে শিশুর হার বেশি। ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুলে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। প্রায় একই রেশিও (সামান্য কম বেশি) কলেজ পর্যায় পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পর্যায়ে গিয়ে নারী শিক্ষা ৩৩ থেকে ৩৮ শতাংশ। এই অবস্থায় সরকারী চাকরিতে বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনও আশাতীত পর্যায়ে পৌঁছানো যায়নি। একটি সূত্রে বলা হয় দেশে সরকারী চাকরিতে পদ আছে প্রায় ১৪ লাখ ৮০ হাজার। অনেক পদে এখনও নিয়োগ না হওয়ায় চাকরিতে আছেন প্রায় ১২ লাখ। যার ২৫ শতাংশেরও নিচে নারী। যে সংখ্যা ২ লাখ ৮৯ হাজার। সরকারী চাকরির পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থায় (এনজিও) নারী কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো এক্সিকিউটিভসহ উচ্চতর কয়েকটি পদ ছাড়া বেশিরভাগ পদেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নিচে। এদিকে কৃষিতে নারী যে কতটা এগিয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ মেলে একদার বিশাল জলরাশি চলনবিলের পাড়ে গেলে। যে চলনবিল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এতটাই অনুন্নত ছিল যে এই দুর্গম বন্ধুর পথে কেউ পা বাড়াত না। বিশাল জলাশয়ের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগত কখনও দুই দিন। সেই চলনবিল এখন শুকিয়ে এমনই যে পাকা সড়ক ধরে সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় যে কোন স্থানে পৌঁছানো যায় অতি অল্প সময়ে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টায়। জলরাশি শুকিয়ে যাওয়ায় জেলেদের মাছ শিকার বন্ধ হলে পুরুষদের বড় অংশ হয়ে যায় পরবাসী। বিলের নারী লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে তুলে নেয়। বর্তমানে যন্ত্র কৃষিতে নারী ট্রেলার চালায়। চারা রোপণ করে। ধান কাটে। যন্ত্রে মাড়াই করে। শ্যালো ইঞ্জিনের চালকলে ধান ভেনে চাল করে। এই নারী ধানসহ নানা সবজি উৎপাদন করে হাটবাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। আবার সংসারও সামাল দেয়। বর্তমানে যেটুকু জলাশয় আছে তা থেকে মাছ তুলে শুঁটকি বানিয়ে ব্যবসা করছে এই নারী। দেশের বেশিরভাগ নারী নানাভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে সচ্ছল হচ্ছে। এই শক্তি অর্জন করে তারা কথা বলতে পারছে। কোনটা ভালো কোনটা ভাল নয় তা বুঝতে শিখেছে। এই অগ্রগতিতে শিক্ষিত নারী অসুস্থ ও অস্বাভাবিক বিয়ের পিঁড়িতে বসছে না। একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণে একজন নারী যতটা ব্যথা সইতে পারে পুরুষ তা পারে না। মেয়েরা কম খেয়ে বেশি কাজ করে। কম ঘুমিয়ে বেশি জেগে সন্তানের লালন করে। হেঁটে গন্তব্যে গিয়ে স্ট্যামিনা ঠিক রাখে। চিকিৎসা বিজ্ঞান যা সমর্থন করে মেয়েরা তাই করছে। একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেন, তারপরও মেয়েদের অগ্রগতিতে বড় অন্তরায় কর্মস্থলকে এখনও নিরাপদ মনে করতে পারছে না তারা। এই অন্তরায় দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
×