ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছেন দু’শতাধিক বিজ্ঞানী

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৭ মার্চ ২০১৫

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছেন দু’শতাধিক বিজ্ঞানী

ফিরোজ মান্না ॥ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) চলছে লাগামহীন অনিয়ম দুর্নীতি। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক বিজ্ঞানী দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না তাঁরা। অযোগ্য অদক্ষ একজন কর্মকর্তাকে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিযোগ দেয়ার বিষয় নিয়ে শুরু হয় এ আন্দোলন। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেও কোন ফল পায়নি। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পে ছলছে হরিলুট- এমন অভিযোগ করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান জনকণ্ঠকে জানান, বিসিএসআইআরে যে অনিয়মের কথা বলে বিজ্ঞানীরা আন্দোলন করছেন, এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দেবে তার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি রিপোর্টে কেউ দোষী প্রমাণীত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা, কারও প্রতি স্বজনপ্রীতি দেখানো হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতাবিরোধী লোকজনের সংখ্যাই বেশি। বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান ডাক্তার কে এম আছাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা আন্দোলন শুরু করে। মালা খান নামের একজন সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওই পদের প্রার্থী হন। এরপর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় তিনি ভুয়া সনদধারী। এই অভিযোগের পর একটি তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়। কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করার পর মন্ত্রণালয় থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে বিসিএসআইআরের তদন্ত কমিটি তদন্ত কাজ নিয়মানুযায়ী বন্ধ হয়ে যায়। মন্ত্রণালয়ের করে দেয়া কমিটি কাজ শুরু করলে বলা যাবে। এখন এ বিষয় নিয়ে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক বিজ্ঞানীর কর্মবিরতি পালনের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা দুঃখজনক। এদিকে, বিসিএসআইআরের করে দেয়া তদন্ত কমিটি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে করা ভুয়া পিএইচডিধারীর আবেদন যাচাই-বাছাই করে বাতিল করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মালা খানকে প্রার্থী থেকে বাদ দেয়া হয়নি। বরং তাঁকেই নিযোগ দেয়ার জন্য নানা মহল থেকে চাপ আসতে থাকে। মালা খানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী সংঘের দুই শতাধিক সদস্য চেয়ারম্যানের কার্যালয় ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেতে হলে সরকারী চাকরি বিধি অনুযায়ী বিজ্ঞান বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীর সঙ্গে ১২ বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান থাকতে হয়। কিন্তু মালা খানের ক্ষেত্রে মাত্র আট বছরের অভিজ্ঞতাকেই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে। বিসিএসআইআরের আওতাধীন ডিআরআইসিএমে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ তিনটি পদে ১৭ জন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনপত্র জমা পড়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে ৬২৫টি, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে ২২টি ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে মাত্র দুটি। ১৩ ফেব্রুয়ারি লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। তবে অভিযোগ উঠায় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানানো হযেছে। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে ৮টি চলমান প্রকল্প রযেছে। এই প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছে হরিলুটের জন্য। ভবন নির্মাণ না করেই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। যে ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, সেই ভবনটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ভবনকেই নতুন ভবন হিসেবে দেখিয়েছে। এরকম অনিয়ম চললেও মন্ত্রণালয় এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ে গঠিত চার সদস্যের কমিটি তিন পদে জমা পড়া মোট ৬৭৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৫৮৬ জনকে যোগ্য হিসেবে সুপারিশ করে। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) পদের জন্য আবেদন করেছিলেন বিসিএসআইআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সানজিদা মুস্তফা ও মালা খান। তাঁদের দুজনকেই অযোগ্য ঘোষণা করে যাচাই-বাছাই কমিটি। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে মালা খানকে পরীক্ষার জন্য গোপনে প্রবেশপত্র হয়। ড. সানজিদা মুস্তফার আবেদনপত্র বাতিল বিষয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৪ বছরের প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান গবেষণামূলক চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলেও কয়েকটি বিষয়ে তাঁর ঘাটতি আছে। আর মালা খানের বিষয়ে বলা হয়, প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান গবেষণামূলক চাকরির ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। দুই বছর সাত মাস জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ছয় বছর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাÑ এই মোট আট বছর সাত মাস প্রথম শ্রেণীর গবেষণা কাজের অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছেন তিনি। মালা খান ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তাঁর স্বামী কে এম মুস্তফা আনোয়ারের প্রতিষ্ঠান প্লাজমা প্লাস এ্যাপ্লিকেশন এ্যান্ড রিসার্স ল্যাবরেটরিজের সহকারী ল্যাবরেটরি ম্যানেজার পদে চাকরির অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন। যাচাই-বাছাই কমিটি একে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান গবেষণামূলক অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য করেনি। কারণ স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের আগের অভিজ্ঞতা প্রথম শ্রেণীর চাকরি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে মালা খান জনকণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে একটি চক্র চক্রান্ত করছে। আমার যদি সনদ নাই থাকে তাহলে আমার আবেদন নিয়োগ কমিটি কেন গ্রহণ করল। আমি এই প্রতিষ্ঠানে কঠোর শ্রম দিয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। একটি প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্বোধন করেছেন। আমি যাতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হতে না পারি তার জন্য চক্রটি নানাভাবে আমাকে হেয় করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম বাদ দিয়ে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করা আবেদনে বলা হয়েছে, বিসিএসআইআরকে বিশ্বমানের গবেষণাগার করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীদের প্রতি আপনার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর সহযোগিতা ও উদারতা বিসিএসআইআর বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই প্রশংসিত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রীধারী মালা খান নিজের অযোগ্যতাকে পাশকাটিয়ে চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। তার জালিয়াতির কাজে সর্বক্ষণিক সহায়তা করছে বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী নিতাই রায় চৌধুরীর ভাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রবীন্দ্র নাথ চৌধুরী। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় (২০০৬ সালে) তৎকালীন জামায়াতী চেয়ারম্যান ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান তাঁকে চাকরি দেন। মালা খান কম্পিটার সায়েন্স বিষয়ে ১৩ জনের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় ১৩তম স্থান অধিকার করে। তারপরও তাঁকে মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে প্রথম স্থানে নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁকে একটি প্রকল্পের পরিচালকও করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাতারাতি আওয়ামী লীগ সেজে যান। গোটা বিসিএসআইআর একদিকে আর মালা খান একদিকে হলেও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোন নজর নেই। গবেষণা কাজও স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি অচল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে দুই মাস ধরে অচলাবস্থা চলছে।
×