ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে;###;উৎসবমুখর ছেঁউড়িয়া

‘এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন-’

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৬ মার্চ ২০১৫

‘এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন-’

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে/বাড়ীর পাশে আরশীনগর সেথা একঘর পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে..../ এমন অসংখ্য মরমী গান সৃষ্টি করেছেন বাউল সম্রাট লালন শাহ। আর লোক সংস্কৃতি আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল উৎসধারা। বাউলগান তারই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলার বাউল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মরমী সাধক ও লোক কবি ফকির লালন শাহের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে লালনের নাম আজ বহির্বিশ্বেও প্রচারিত। লালনের গানে কেবল অধ্যত্ম দর্শনই নয়, বাংলার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের কথাও প্রতিফলিত হয়েছে। লালনের গান কেবল পল্লী বাংলার হাজার হাজার মানুষকেই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেনি; বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও করেছে অনুপ্রাণিত। প্রকৃতপক্ষে লালন শাহ আজ লৌকিক বাংলার কিংবদন্তীর সঙ্গীত নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। আধ্যাত্মিক সাধক লালনের ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসব উপলক্ষে এবার কুষ্টিয়া লালন একাডেমি আয়োজন করেছে পাঁচদিনব্যাপী বাউল সমাবেশ। ‘এই মানুষ আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন’ লালনের অমর এ বাণীকে বুকে ধারণ করে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় বুধবার দোল পূর্ণিমার রাত থেকে ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয়েছে এই উৎসব। লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে পাঁচদিনের এ উৎসবের উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ। এতে অতিথি ছিলেন বিজিবি যশোরের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোঃ শহীদুল ইসলাম, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে.এম. রাহাতুল ইসলাম, পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সেলিম হক। তবে সাধুসংঘের নিয়মানুযায়ী দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ‘রাখল সেবা’র মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাউলদের দেড় দিনের মূল উৎসব। চলবে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘পূর্ণ সেবা’ পর্যন্ত। স্মরণোৎসব উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ায় লালনের আঁখড়াবাড়ি চত্বর পরিণত হয়েছে এক উৎসবের পল্লীতে। দেশ-বিদেশ থেকে আগমন ঘটেছে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের। স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা, গান আর লোকশিল্প মেলা নিয়ে বসেছে জমজমাট এই আসর। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান। নাটোর থেকে দোল পূর্ণিমায় আসা লালন অনুসারী রুস্তম শাহ গুরু লালন শাহ সম্পর্কে বলেন, গুরু কিংবা লালন যাই বলুন ওনারাতো ধীয়ানলোকে বিরাজ করেন। হাত দিয়ে দেখানোর কিছু নাই। তাঁর ভাষায়-‘গুরুকেই আমি লালন ভাবি। গুরু ভাবনায় থাকতে থাকতে কখনও আবার নিজের মধ্যেই লালন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। তখন মন অন্যরকম হয়ে যায়। গানের সুর ভাল হয়। মনে হয় যার গান সেই গাইছে আমি খালি খালি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু আমার রূপে গুরুর রূপ বিলীন করে’। অপরদিকে আলমডাঙ্গা থেকে আসা দুলাল সাঁই বলেন, ‘আমরা সাঁইজির দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন করতে এখানে এসেছি। আমাদের অনুষ্ঠান দু’দিনেই শেষ হয়ে যায়। বাউল সাধুরা লৌকিকতা পছন্দ করেন না। তারা সাঁইজিকে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানাতে এবং নিজের মধ্যে ভাববিনিময় খুঁজতেই ব্যস্ত থাকেন। সাধুরা বিশ্বাস করে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া সম্ভব। তারা এখানে এসেছে সাঁইজির সাক্ষাৎ পেতে। সেই সঙ্গে দেখা হয় তাঁর পুণ্যভূমিও’। লালন গবেষকদের কারও কারও মতে, দোল পূর্ণিমার সঙ্গে প্রেমময় আত্মার সম্পর্ক স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর এই রাতে লালন শাহ নিজেই ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে ঘটা করে এ উৎসবটি পালন করতেন। সেই থেকে লালনের অগণিত ভক্ত ও অনুসারীরা আজও এ দিনটিকে ধারাবাহিকভাবে পালন করে আসছে। লালনের সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে লালন একাডেমিও প্রতিবছর এ উৎসবটিকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ হিসাবে পালন করে আসছে। এবার স্মরণোৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে অন্ততঃ অর্ধলাখ লালনভক্ত, অনুসারী, দর্শক-শ্রোতা ও বাউলের সমাবেশ ঘটছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাঁদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বাংলার বাউল শিরোমণি ফকির লালন শাহের আঁখড়া চত্বর। রাতভর চলছে লালনের আধ্যাত্মিক সব গান ও তত্ত্ব আলোচনা। কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম জানান, এ উৎসবকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য কোন নাশকতার আশঙ্কায় অনুষ্ঠানস্থলে নেয়া হচ্ছে কড়া পুলিশী ব্যবস্থা। মোতায়েন করা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। লালনের জীবন-কাহিনী অনেকাংশেই রহস্যাবৃত। তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন তথ্য, জনশ্রুতি বা অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। লালনের জন্ম, জাত ও ধর্ম নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। লালন নিজেও তাঁর জাত ধর্ম সম্পর্কে নিষ্পৃহ ও উদাসীন ছিলেন। তাঁর জাত-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাই তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে’। জানা যায়, লালন শাহ ১৭৭৪ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া (তৎকালীন নদীয়া) জেলার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত গড়াই নদীর তীরবর্তী ভাড়ারা গ্রামের (চাপড়া গ্রাম সংলগ্ন) এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাধব কর ও মাতা পদ্মাবতী। মতান্তরে, লালন যশোর জেলার হরিণাকু- থানার (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা) হরিশপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে ১৭৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দরিবুলাহ দেওয়ান ও মাতার নাম আমিনা খাতুন। লালন ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। আর্থিক সঙ্কটের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি। শৈশবে পিতৃ বিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তাঁর ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। ইতোমধ্যেই তাঁর বিয়ে হয়। সাংসারিক চিন্তা ও আত্মীয়বর্গের বৈরিতা তাকে বিশেষ পীড়িত করে তোলে। এক পর্যায়ে লালন সমাজ ও স্বজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যথিত ও অভিমানে চিরতরে গৃহত্যাগ করেন। পরে তিনি সিরাজ সাঁই নামের এক তত্ত্বজ্ঞসিদ্ধ বাউল গুরুর সান্নিধ্যে এসে বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণের পর গুরুর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদীর (বর্তমানে বিলুপ্ত) তীরে ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাংলা ১৮২৩ সাল মতান্তরে ১৮৩০ সাল নাগাদ আঁখড়া স্থাপন করেন। এখানে তিনি স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের উদার সাহায্যে ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাদের দানে ও অনুদানেই আঁখড়াটি গঠে ওঠে। অল্প দিনের মধ্যেই লালনের প্রভাব ও পরিচিতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, লালন সিরাজ সাঁই এর নিকট দীক্ষালাভের পর ফকির নাম গ্রহণ করে ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের ভেতর একটি আম গাছের নিচে বসে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে গ্রামের লোকেরা আঁখড়া তৈরি করে দেয়। লালনের সঙ্গীত ছিল অধ্যাত্ম ভাবাবেগের অমিয় ফসল। লালন মুখে মুুখে গান রচনা করতেন আর তার শিষ্যরা সেগুলো খাতায় লিখে রাখতেন। লিপিকারের কাজ করতেন মানিকশাহ ওরফে মানিক পণ্ডিত ও মনিরুদ্দীন শাহ।
×