ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

দরকার কঠোরতর নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৬ মার্চ ২০১৫

দরকার কঠোরতর নিয়ন্ত্রণ

দেশীয় ব্যাংকগুলোর ঋণের ওপর সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত বলে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা অহরহই অভিযোগ করেন। সুদের ওপর সুদ এই আরেকটা অভিযোগ। তারপর রয়েছে নানা ধরনের চার্জ। ট্রাঞ্জেকশন কস্টের কথা নাই বা বললাম। দেখা যায়, এসব অভিযোগের কথা বলে এক সময় ব্যবসায়ীরা দাবি করলেন তাদের বিদেশ থেকে ঋণ করতে দিতে হবে। বিদেশী ঋণের ওপর সুদের হার কম। তারা ঋণ ‘প্রসেসিং’ করতেও সময় নেয় না। ফলে ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা হয়। তারা সময়মতো, পরিমাণমতো কম সুদে ঋণ পান, যার ফলে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারেন বিদেশের বাজারেÑ এসব যুক্তি যখন তুলে ধরা হলো তখন আমার মতো অনেকেই বেশকিছুটা নরম হয়ে যান। ব্যবসায়ীদের বিদেশে ঋণ করতে দেয়া হোক। বিষয়টি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সাতবার ভাবতে হয়। কারণ বিদেশের ঋণ হবে ডলারে, পরিশোধও করতে হবে ডলারে। ডলার আমাদের অফুরন্ত নয়। অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবি চলাকালেই ধীরে ধীরে আমাদের বৈদিশেক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়তে থাকে। তখন আরও একটি দাবি তোলা হয়। বলা হয়, শুধু ঋণ করা নয়, বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিদেশে বিনিয়োগ করতেও দিতে হবে। আরেক কথায় আমাদের ‘ক্যাপিটাল এ্যাকাউন্টকেও’ রূপান্তরযোগ্য (কনভার্টিবল) করতে হবে যা এখন তা নয়। আমাদের ডলারের ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্ট’ বর্তমানে বেশকিছুটা রূপান্তরযোগ্য। দৈনন্দিন খরচা যেমন বিদেশে ভ্রমণ, বিদেশে চিকিৎসা ও বিদেশী বিনিয়োগের ওপর প্রাপ্ত লভ্যাংশ ইত্যাদি বিদেশে খরচ ও প্রেরণে এখন খুব বেশি বাধা নেই। একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতিরেকে এখন ডলার পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ভাল পরিমাণের ডলারই। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও তাদের রফতানি আয়ের একটা অংশ বিপণনের জন্য রাখতে পারেন। এসবই সম্ভব হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকার কারণে এবং একই কারণে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য ডলার প্রেরণের অনুমতিও চান ব্যবসায়ীরা। দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা দিচ্ছে না। তবে ব্যবসায়ীদের বিদেশে ঋণ করতে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কারণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ যা এখন ২৩ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার। খেলা কথা নয়, সাত-আট মাসের আমদানির সমপরিমাণ ডলার। বিশাল অর্জন বাংলাদেশের। ২০০৯-২০১৫ এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সাতগুণ বেড়েছে। উল্লেখ্য, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ স্বাধীনতার পর পর আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। আমার মনে আছে, তখন ২৫-৫০ ডলারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে হতো। গবর্নর, ডেপুটি গবর্নর, নির্বাহী পরিচালকদের কাছে তদ্বির করতে হতো সামান্য ডলারের জন্য। আর আজ? সার্কদেশে যাওয়ার জন্যই চার হাজার ডলার বিনা অনুমতিতে পাওয়া যায়। ডলারের মূল্যমানও যথেষ্ট স্থিতিশীল। বছর তিনেক আগে মনে হয়েছিল ডলারের দাম বোধ হয় ১০০ টাকা হয়ে যাবে। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল। সেই অবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। ডলারের কোন চাহিদা নেই। দাম স্থিতিশীল। এমন একটা পরিস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের ব্যবসায়ীদের অনুমতি দিচ্ছে বিদেশে ঋণ দিতে। যখন এই প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন আমি আমার কলামে কতগুলো সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলাম। বলেছিলামÑ ধীরে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধীরে। বলেছিলাম অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। বলেছিলাম আমাদের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর ট্রেক রেকর্ড দেখে। দেখা যাচ্ছে, আমার আশঙ্কা ফলতে শুরু করেছে। ঘটনা খুলে বলি। কয়েক দিন পর পরই খবর ছাপা হচ্ছে যে, ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকার অপব্যবহার করছেন। এতে ক্ষতি কী? ক্ষতি আছে। ঋণটা ডলারে। যদি ব্যবসায়ী কাম- ঋণগ্রহীতা ডলারের ঋণ পরিশোধে অক্ষম হন তাহলে যে দেশীয় ব্যাংকের মারফত ঋণটি করা হয়েছে, তাকে সেই টাকা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককেই সেই ডলার যোগান দিতে হবে। আনুমানিক কত পরিমাণ ডলার? সঠিক হিসাব আমার কাছে নেই। তবে একটি খবরে দেখলাম ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ৬১৬ কোটি ডলারের মতো ঋণ বিদেশ থেকে করেছেন। এর টাকা মূল্য ৮০ টাকা দরে হয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। সব টাকা এই মুহূর্তে ডলারে পরিশোধ করতে হবে এ কথা আমি বলছি না। অবশ্য আমি জানি না ঋণগুলো কত মেয়াদের। এগুলো কি দীর্ঘমেয়াদী ঋণ, না এগুলো স্বল্পমেয়াদী ঋণ তা আমার জানা নেই। তবে কাগজে দেখলাম এই ঋণগুলো করার অনুমতি দেয়া হয়েছে একটা শর্তে। শর্তটি হলো বিনিয়োগ। তার অর্থ ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ করে তা দেশে বিনিয়োগ করবে শিল্পে। এর অর্থ- দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বলে ধরে নিতে হয়। তাহলে ঋণ পাওয়ার পরের কাজ হচ্ছে শিল্প স্থাপন করা। সেই শিল্প স্থাপনের পর রফতানি কাজ শুরু করা। রফতানির টাকা থেকে দৈনন্দিন খরচা মেটানোর পর একটা ‘তহবিল’ গঠন করা যা দিয়ে ঠিক সময়ে সুদে-আসলে বিদেশী ঋণ ডলারে পরিশোধ করা যায়। এটাই প্রত্যাশা। এটাই বিদেশী ঋণ করার প্রধানতম শর্ত। এটা নয় যে, বিদেশী ঋণের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিজস্ব ডলার থেকে পরিশোধ করবে। আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছি ব্যবসায়ীদের একটা অংশ বিদেশী ঋণের টাকা বিনিয়োগ না করে অন্যত্র সরিয়ে দিচ্ছেন। এই মর্মে খবর ছাপা হচ্ছে কয়েক দিন পর পর। আরও দুঃখের বিষয় এমন সব কোম্পানির মালিকরা এ কাজ করছেন যারা নামী-দামী, যারা নামী-দামী ট্রেডবডির নেতা ও সদস্য। প্রতিপত্তি সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা এটা করলে কিছুটা সান্ত¡না পাওয়া যেত। না, তা নয়। একটি দৈনিকে দেখলাম ‘এপেক্স’, ‘প্রাণ’, ‘অনন্ত’, ‘নাজ বাংলাদেশ লিমিটেড’ ও ‘ইপিলিয়ন লিমিটেড’এর মতো কোম্পানি এই কাজটি করছে। এতে সহায়তা করছে দেশে- বিদেশী ব্যাংক। দেখা যাচ্ছে তারা ডলার ঋণ নিয়ে দেশীয় টাকায় ঋণ পরিশোধ করছে। আবার কেউ কেউ ডলারের টাকা বিনিয়োগ না করে মেয়াদী ঋণ করছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সাবধান করে দিয়েছে। কোন কোন ঋণগ্রহীতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কড়া পদক্ষেপের কথা আমাদের জানিয়েছে। উপরে এই যে চিত্র দিলাম তা এক কথায় অনভিপ্রেত চিত্র এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা। দেশের ভেতরে দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণগ্রহীতাদের একাংশ অনুচিত কা- ঘটাবেন, আবার একই অঘটন ঘটাবেন বিদেশের ঋণের ক্ষেত্রে, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে বেশকিছু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং হবে। এ কথা ঠিক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে এই মুহূর্তে প্রচুর ডলার আছে। এর কারণ অনেক। রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ও রফতানি প্রবৃদ্ধি মোটামুটি সন্তোষজনক থাকায় ডলারের সরবরাহ ঠিক আছে। বিপরীতে ডলার খরচ কম হচ্ছে কয়েকটি কারণে। খাদ্য খাতে প্রচুর ডলার খরচ হতো খাদ্যশস্য আমদানির জন্য। এখন খাদ্য খাতে ডলারের জন্য চাপ নেই। খাদ্য আমদানি সর্বনিম্ন। বরং আমরা কিছু খাদ্য এবার রফতানি করেছি। সবচেয়ে বড় কথা তেল আমদানির খরচ কম। বলা যায় প্রায় অর্ধেক। এটা আমাদের বড় আমদানি খরচের খাত। এছাড়া সাধারণ ভোগ্যপণ্য আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এসবের দামও এখন আন্তর্জাতিক বাজারে কম। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিও আগের মতো নয়। এসব কারণে এখন আমাদের হাতে প্রচুর ডলার। কিন্তু আমরা হলফ করে বলতে পারি না এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলবে। কোন কারণে উল্টো ঘটনা ঘটলে আমাদের ডলারে টান পড়তে পারে। তখন কে দেখবে আমাদের স্বার্থ? এটা একটা প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ব্যাংকিং খাতে প্রচুর তারল্য এখন। ব্যাংকে ব্যাংকে টাকার পাহাড়। ঋণের চাহিদা নেই। ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না। ফলে ব্যাংকের লাভপ্রদাতা চাপের মুখে। ঋণের সম্প্রসারণ না হওয়ায় শতকরা হিসাবে শ্রেণীবিন্যাশিত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে আবার পুঁজির প্রয়োজনীয়তা। অতিরিক্ত তারল্য দশ সমস্যার সৃষ্টি করছে। অথচ এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিদেশে ঋণ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। তারা আবার সেই ডলার টাকায় রূপান্তরিত করে দেশীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে, মেয়াদী আমানত রাখছে। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল। হিতে বিপরীত হচ্ছে না-কি? এক সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আরেক সমস্যার জন্ম দেয়া হচ্ছে না-কি? এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলব প্রতিটি ডলারের সদ্ব্যবহার করতে। ডলার ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেলে রিজার্ভ শেষ হতে বেশি দিন লাগবে না। তাই নয় কি? লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×