ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেনী কুইয়া

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৫ মার্চ ২০১৫

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

(৪ মার্চের পর) আমাদের দু’জনের কাছে কিন্তু মনে হয়েছে বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সম্বিত ফিরে পেয়েছি। বুঝিইনি যে, এরপরও বেশ কিছুক্ষণ আমাদের কোন হুঁশ ছিল না। সবাই বলতে লাগল যে, আল্লাহ আমাদের এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। যা হোক, আবার আমরা হাঁটা শুরু করলাম বাড়ির দিকে। বৃষ্টি তখনও থামেনি, ঝরছে মুষলধারে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে। সঠিক মনে নেই, তবে বোধ হয় তার দু’তিন দিন পরেই, খুব সম্ভবত এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে আমাদের শহরে ফিরে যাওয়া ঠিক হলো। যাওয়ার দিন এসে গেল। সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম আমরা একটা নৌকায় করে। ছোট একটা নৌকা। ঠিক হলো কালুরঘাট ব্রিজের কাছাকাছি যাব নৌকায় করে। তারপর গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। সেখান থেকে বাস নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের চকবাজার পর্যন্ত। চকবাজার থেকে হেঁটে জামালখান এলাকায় আমাদের বাসায়। আমাদের নৌকা কালুরঘাট ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই দেখতে পেলাম ব্রিজের ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী টহল দিচ্ছে। মাঝি খুব সাবধানে বৈঠা বাইছিল পানিতে কোন শব্দ না করে। পাড়ঘেঁষে চলছিল আমাদের নৌকা। আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করল মাঝি। মনে হচ্ছিল আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও হয়ত পাকিরা শুনে ফেলতে পারে। ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে, একটু আড়ালে নৌকাটা থামাল মাঝি। কোন শব্দ না করে এক এক করে আমরা সবাই নামলাম নৌকা থেকে। যার যার বাক্স-পেটরা, পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম গ্রামের রাস্তা দিয়ে। পথে পথে মানুষজন আমাদের বার বার নিষেধ করছিল শহরে ফিরে যেতে। ‘আপনাদের কি মাথা খারাপ নাকি? মানুষ শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে আসছে, আর আপনারা ফিরে যাচ্ছেন শহরে!’ অনেকে তো তাদের বাড়িতে থাকার জন্যও বললেন। পথে পথে গ্রামের মানুষ আমাদের পানি, রুটি, মুড়ি, গুড় ইত্যাদি নানারকম খাওয়া-দাওয়া দিয়ে দিলেন। এভাবে মাইল ছয়-সাত হাঁটার পর বাবুল’দা একটা লোককে নিকটস্থ বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে কোন্দিকে যেতে হবে জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটা দেখিয়ে দেয়ার পর আবার হাঁটা শুরু। দেড়-দুই মাইল হাঁটার পর এক পথচারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’ বাসস্ট্যান্ডের কথা বলায় বললেন, ‘আপনারা তো উল্টাদিকে যাচ্ছেন। সামনে তো পাকিস্তানী হানাদারদের ক্যাম্প!’ তখন বুঝলাম আগে যে লোকটা বাসস্ট্যান্ডের পথ বাতলে দিয়েছিল সে ছিল পাকিদের দালাল। ‘আর একটু হলেই তো ঐ পাকিস্তানী জানোয়ারদের হাতে পড়তেন।’ বললেন লোকটা। তারপর উনি সঠিক পথটা দেখিয়ে দিলেন। এভাবে কখনও গ্রামের মাটির রাস্তা দিয়ে, কখনও কারও বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে, কখনওবা কারও কাঁচা পায়খানার পেছন দিয়ে হেঁটে, প্রায় মাইল সাত-আট পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম বাসস্ট্যান্ডে। রাস্তার দু’পাশে প্রায় সমস্ত বাড়িঘর পোড়া। কোথাও কেউ নেই। শুধু তিন-চারজন লোক এদিক-সেদিক দাঁড়িয়ে। খুব সম্ভবত আমাদেরই মতো বাসের অপেক্ষায়। আমাদের বাড়িওয়ালা কাশেম সাহেবের এই বাড়িগুলো অনেকটা ইংরেজি ‘ডি’ অক্ষরের মতো সাজানো। ধোপাপাড়ার দিকে পেছন করে দোতলা বিল্ডিংটা, আর সামনের দিকে বাঁকিয়ে সাজানো টিনশেডের ঘরগুলো। মাঝখানে এবং একপাশে উঠোনের মতো জায়গা, তাতে ইট বিছানো। বুটের খটখট আওয়াজটা ঐ ইট বিছানো থাকাতেই শুনতে পেলাম। মনে হলো, খুনীগুলো পেছনের দিক দিয়েই আমাদের আঙিনাতে ঢুকেছে। মা-বাবার শোবার ঘরটা এই পেছনের দিকেই। এই ঘরের একটা দরজা আর জানালাটা আবার এই দিকের আঙিনা মুখ করে। ভাগ্য ভাল জানালাটা কাঠের। বাইরে থেকে দেখা যায় না। উর্দুতে কথা বলছিল ওরা। রাজাকারদের ভাঙ্গা উর্দু শুনে বুঝলাম, ওরা পাকিদের বোঝাচ্ছে যে এই সমস্ত ঘরে কেউ নেই, সবাই পালিয়েছে। আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছিলাম খুব সাবধানে। মনে হচ্ছিল আমাদের হৃদস্পন্দনের শব্দেই ঘর ভরে গেছে। সবাই একেবারে পাথরের মতো জমে গেছি। ঘণ্টাখানেক পরে পিকাপ ট্রাকটা ফিরে এলো। মালপত্র দিয়ে ঠাসা। ‘পুরো এলাকা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। এর মধ্যেই যেভাবে পেরেছি শুধু জিনিসপত্রগুলো ট্রাকের ওপর ছুড়ে ছুড়ে ফেলেছি।’ বাবা আর বাবুল’দা বললেন। সবাই হাতে হাতে মালামাল ট্রাক থেকে নামিয়ে নিচে হলঘরে নিয়ে গেলাম। এরপর সবাই মিলে তাকিয়ে আছি আমাদের পাড়ার দিকে। কিছুক্ষণ পর আগুনে লেলিহান শিখা কমে এলো। তার পরিবর্তে সাদা ধোঁয়া ওঠা শুরু করল। কে যেন বলে উঠল, ‘দমকল আইসে মনে হয়। পানি ঢালতাছে।’ যাহোক, কিছুক্ষণ পর আগুনটা পুরোপুরি নিভে গিয়ে সাদা ধোঁয়া উঠতে লাগল। আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ, আমাদের ঘরভর্তি চাল, ডাল আর নানারকম খাবার-দাবারে। ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ। যাচ্ছি আন্দরকিল্লায় এমইএস হাই স্কুলের দিকে খোঁজখবর নিতে। হঠাৎ আশপাশে মানুষের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হলো। সবাই খুশি হয়ে বলছে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে সবাইকে বলছে ঘরে চলে যেতে। আমার মধ্যেও বিদ্যুত তরঙ্গের মতো খুশির একটা শিহরণ বয়ে গেল। এর মধ্যে একদিন বিকেল বেলা আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি উত্তর দিক থেকে অনেক উঁচু দিয়ে একটা প্লেন আসছে। কোন সাইরেন বাজছে না দেখে ধরে নিলাম পাকিদের ওটা। প্লেনটা সোজা উড়ে গেল পতেঙ্গার দিকে। একটু পরেই দেখতে পেলাম দুটো কি তিনটি কি যেন পড়ছে প্লেনটা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম ওগুলো বোমা এবং প্লেনটা পাকিদের নয়। ছাদে বড়রাও ছিলেন। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বোমার দিকে। তখনও কোন সাইরেন নেই। কয়েক মুহূর্ত পরেই বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল যেন পুরো চট্টগ্রাম শহর। আর ঠিক তখনই পোঁ পোঁ আওয়াজে বেজে উঠল সাইরেন। আমরা ছেলে বুড়ো সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। সবাই বুঝতে পারছিলাম পতেঙ্গায় পাকিদের জাহাজে বোমা ফেলা হয়েছে। একটু পরে ওদিক থেকে আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেল। প্লেনটা ততক্ষণে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আকাশে ফুলের মতো ফুটে রয়েছে বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলার ধোঁয়া। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকালবেলা নাস্তার পর্ব শেষ করে সবাই এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হঠাৎ বড় রাস্তার দিক থেকে ভেসে এলো অনেক কণ্ঠের স্লোগান- ‘জয় বাংলা’। মুহূর্তে; যেন সবাই জমে গেল। সবার কথা থেমে গেল। আমরা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভুল শুনিনি তো ? কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার শোনা গেল, ‘জয় বাংলা’। এরপর মুহুর্মুহু গগনবিদারী জয় বাংলা সেøাগানে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস। বন্দুকের নল থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের মতো আমরা কিশোর তরুণ সবাই একসঙ্গে ছুটে বড় রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে বড়রা নিষেধ করছিলেন এখনি এভাবে বড় রাস্তায় যেতে। ভাল করে দেখে শুনে পরে যেতে বলছিলেন। কে শোনে কার কথা। রাস্তায় এসে দেখি লোকে লোকারণ্য বড় রাস্তা। সবাই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, ‘জয় বাংলা’। আমরা গলির মাথায় জামালখান রোডের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। তার-স্বরে স্লোগান দিচ্ছি- ‘জয় বাংলা’। এমন সময় বুড্ডিস্ট টেম্পলের দিক থেকে সাদা রঙের একটা প্রাইভেটকার ছুটে এলো। ইতোমধ্যে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে রাজাকার ক্যাম্প থেকে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে নিয়ে গেল। দুপুরের দিকে শুনলাম বিকেল ৪টায় পাকিস্তানী জানোয়াররা রেসকোর্সে (এখনকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করবে। ওই খবরটা শোনার পর মনে হলো আমি আনন্দের সাগরে ভাসছি। বিগত নয় মাসের আতঙ্ক, বিভীষিকা সেই মুহূর্তে বেমালুম ভুলে গেলাম। শুধু মনে হলো, অবশেষে আমরা স্বাধীন! আমরা বীরের মতো যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ পেয়েছি !! আমাদের নিজস্ব লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছি !! (সমাপ্ত) লেখক : প্রাবন্ধিক kenû[email protected]
×