ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এমন হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৪ মার্চ ২০১৫

এমন হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না

কেন আমাদের মেধাবী, প্রগতিশীল শিক্ষক-তরুণরা মৌলবাদী জঙ্গীদের হাতে খুন হবে? কেন আমরা এদের হাতে আক্রান্ত হব বার বার? আর প্রতিবাদ সভায়, শোকসভায় বার বার কেন আমাদের রাজপথে দাঁড়াতে হবে? কেন ওরা, জঙ্গী-মৌলবাদী খুনীরা গ্রেফতার হয় না? হলেও দ্রুত জামিনে মুক্তি পায়? আবারও তারা একই কায়দায় হামলা চালাতে সক্ষম হয়? অভিজিৎ আমাদের মেধাবী শিক্ষক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা স্যার অজয় রায়ের বড় ছেলে। বইমেলা থেকে বের হয়ে টিএসসির উল্টোদিকের ফুটপাতে কয়েকজন জঙ্গীর হাতে নিগত হন। যে চত্বরটি তরুণ-তরুণী, পুলিশ, রিক্সাযাত্রী, মেলা ফেরত তরুণ-তরুণীদের ভিড়ে ঠাসা? তরুণ-তরুণীদের ভিড়ের ভেতর যদি জঙ্গীরা খুন করতে পারে, খুন করে পুলিশ এবং তরুণদের নিষ্ক্রিয়তায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে এ ঘটনাকে আমরা কি বলব? অন্তত তরুণ প্রজন্মকে, পুলিশের সামনে চাপাতির আঘাতে মানুষকে নিহত হতে দেখে, এমনকি অভিজিতের স্ত্রীর চিৎকারেও ছুটে এসে সক্রিয়ভাবে এ দু’জনকে হামলা থেকে রক্ষায়, হাসপাতালে দ্রুত নেয়া এবং খুনীদের তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলার সক্রিয় ভূমিকায় না দেখে গভীর আঘাত পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে খুন করতে পারা ও পালিয়ে যেতে পারা- এ দুটি সম্ভব হয়েছে পুলিশ দল ও ওখানে উপস্থিত তরুণদের নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত থাকার কারণে, যা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ স্পটে সাড়ে আটটা, পৌনে নয়টার সময় যেসব তরুণ-তরুণী, ফেরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালা এবং সর্বোপরি পুলিশের দল উপস্থিত ছিল, তারা কেন খুনীদের বাধা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল না? এমনকি স্ত্রীর সাহায্যের আহ্বানেও পুলিশ কেন নীরবে দণ্ডায়মান ছিল? এ আচরণ ক্ষমার অযোগ্যÑ এ কথা বলাবাহুল্য। প্রশাসনের দায়িত্ব পাওয়ার পরও যারা সেই জোট আমলে ড. ইউনুস, ড. তাহের, পরে অধ্যাপক শফিউর, ড. হুমায়ুন আজাদ, পরে গণজাগরণের রাজীব, দীপ হত্যা, রাজনীতিক নূরুল ইসলাম হত্যাসহ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলোতে পত্রিকায় নাম-পরিচয় প্রকাশের পরও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা ও খুনী-হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেবার কাজটি এখনও সম্পন্ন করতে পারলো না- তারা যারাই হোক, তারাও খুনী অপরাধীদের সহায়তাকারী বলে গণ্য হবে এবং তাদেরও কৈফিয়ত তলব করা দরকার। শাহ এএমএস কিবরিয়ার বিচার কাজ শুরু এখনও কেন হতে পারছে না? এটা সবাই বোঝে যে, আসামি হারিছ চৌধুরী ও অন্যরা সে সময়ের ক্ষমতার দণ্ডমু-ের মালিক হাওয়া ভবনের কর্তা তারেকের নির্দেশ ছাড়া কখনোই এত বড় মাপের একজন রাজনীতিক-কূটনীতিক হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে পারে না! একই সঙ্গে একটা হেলিকপ্টার না দিয়ে তাঁর মৃত্যুকে অবধারিত করেছিল জোট সরকারের যে স্পীকার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাদেরকেও এই কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি করা প্রয়োজন ছিলো। এদের সবার যোগসাজশে সেদিন শাহ কিবরিয়ার মতো মেধাবী কূটনীতিক-রাজনীতিককে হত্যা করা হয়েছিল। বারবার বলা হচ্ছে- এসব হত্যা মামলার আসামি খুনীদের অজামিনযোগ্য গ্রেফতার করতে হবে। এ সঙ্গে অবশ্যই দেখতে হবে ড. ইউনুস, ড. তাহেরের সেই খুনী সালেহী শিবিরের অন্যরা কোথায়? রাজীব, অভিজিৎ, হুমায়ুন আজাদ, দীপ, ফারুকী ও অন্যদের হত্যাকারীরাইবা কোথায়? তাদের মধ্যে যাদের জামিন হয়েছে তাদেরকে কোন্্ আইনজীবী মাধ্যমে বিচারক জামিন দিয়েছেন? প্রয়োজনে এই ব্যাপারে আইন করুন। আইন না করা পর্যন্ত, খুনীদের বিচারের আওতায় আনা কঠিন হয়ে যাবে। ওরা নানা সুযোগে জামিন পেয়ে যাবে। এসব বাধা যত দ্রুত সম্ভব দূর করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে- খুনীর জামিন হবে কেন? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া প্রত্যক্ষভাবে আইএস-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যার অধীনে জামায়াত ও এর আদর্শের বিভিন্ন নামের ছোট ছোট মৌলবাদী দল ঐক্যবদ্ধভাবে যেসব কাজ করছে তা স্পষ্টতই মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক উন্নয়নশীল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ধ্বংস করে দেয়া- এতে কোন সন্দেহ নেই। জাতিকে স্মরণ করতে হবে- ’৭১-এ জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ’৭৫-এর খুনীদের, ’৭১-এর খুনীদের পুরস্কৃত করে, বিচার থেকে মুক্তি দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে জানিয়েছিলেন আসলে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে স্যাবোটাজ করতে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি পাকিস্তানপন্থী । তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও ছেলে তারেক রহমান ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের প্রতি একই রকম মিত্রতার বন্ধন রক্ষা করেছেন। বিএনপিকে আল কায়দা নেতা জাওয়াহিরি যে তাদের মিত্র হয়ে মুসলমানদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টিকারী প্রধান মিত্র গণ্য করতে কোন ভুল করেনি এতে কোন সন্দেহ থাকে না। বরং এর পরে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় ইসলামী মৌলবাদী দল আইএসের উত্থান হলে আইএস প্রধান বক্তব্য দিয়েছিল ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তাদের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে তথ্য জেনে বাঙালী বিশ্বাস করেনি এবং বক্তব্যটিকে ভিত্তিহীন হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। বাস্তবতা ক’দিনের মধ্যে প্রমাণ করল খালেদা জিয়া, প্রতিদিন পেট্রোলবোমা হামলা করে জীবন্ত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করে পুড়িয়ে মেরে, যে একই অপরাধ আইএস ইরাকে-সিরিয়ায় করে চলেছে। অর্থাৎ আল কায়দা ও আইএসের নেত্রী হিসেবে বর্তমানে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, পরিবহন- সব ধ্বংস করার তৎপরতা পরিচালনা করছে, এটি প্রকৃত সত্য। পাঠক স্মরণ করুন, বাংলাভাই গং যাদের তারেক-খালেদা-নিজামী তৈরি করেছিল, গাছতলায় বিচার করে প্রধানত আওয়ামী লীগ কর্মী, বামপন্থী কর্মীদের হত্যা, গুম, পঙ্গু করা শুরু করেছিল। এখনও সুযোগ পেলে গাছতলায় গ্রাম্য ফতোয়াবাজ উগ্র মৌলবাদী জামায়াতীরা বিচারালয় বসাবে, দোররা মারবে, সর্বসমক্ষে পাথর মেরে হত্যা করবে, স্কুল বন্ধ করা হবে, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করবে, গার্মেন্টস বন্ধ হবে, মেয়েদের কৃষি-শিল্পে কাজ করা বন্ধ হবে, আদালত, আধুনিক আইন-সব বন্ধ হবে। এখনও খালেদার একক ইচ্ছায় পরিচালিত হত্যাকা-ের পরও পথে-ঘাটে কিছু মানুষকে বলতে শোনা যাচ্ছে- দুই নেত্রী রাজনীতিকে সুস্থ করতে পারেন, দু’জনে ক্ষমতা দখলের, পদ দখল ও পদ ধরে রাখার লড়াই করছেন, যাতে সাধারণের প্রাণ যাচ্ছে, ইত্যাদি! অর্থাৎ যে দুটি বড় সংবাদপত্র দীর্ঘদিন যাবত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী নেত্রীকে যুদ্ধাপরাধী মিত্র ও হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞের পরিচালক নেত্রীর সঙ্গে একই পাল্লায় পরিমাপের ‘প্রবণতা’ জনমানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে, তারই সাক্ষ্য বহন করছে ওদের বক্তব্যগুলো। ঐ হলুদ সাংবাদিক যারা মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন তাঁরা বর্তমানে যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থাকবে নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে, সে লড়াইটি চলছে, তা জেনে, বুঝেও এই দুই দুরাত্মা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ধ্বংসের পক্ষ সমর্থন করে যাচ্ছে- এর চাইতে পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে। খালেদা আর শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও তাদের তুলনীয় ভাবার দুষ্ট কৌশল এরা দীর্ঘকাল চালিয়ে যাচ্ছে, কোন কোন মানুষ তা বিশ্বাস করছে- এটিই শঙ্কার বিষয়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠককে জানাতে চাই। আকস্মিকভাবে ঢাকার জামায়াত অধ্যুষিত এলাকার এক মুদি দোকানদারের মুখ থেকে কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে এক অমোঘ সত্য। দোকানি সহজেই বলে ফেলল, ‘এটা তো আমাদের (অর্থাৎ জামায়াত-মৌলবাদীদের) মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এতে আমাদের জয়ী হতে হবে, আমাদের নেতাদের মুক্ত করে আনলে আমাদের শত্রুরা পরাজিত হবে। ’৭১- এ ওরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, এই ২০১৫তে আমরা (জামায়াতী মৌলবাদীরা) মুক্তিযুদ্ধ করছি।’ মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা জেগে উঠুন, খলনায়ক, খলনায়িকাকে চিনুন, কর্তব্য ঠিক করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, নতুবা আবার কোন অভিজিৎকে হারাব। মসজিদে মসজিদে, পাড়া-মহল্লায় কিভাবে ওদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, কত পরিকল্পিতভাবে, তার একটি ছোট কিন্তু ভয়াবহ উদাহরণ ঐ মুদি দোকানদারটি। মুক্তিযুদ্ধপন্থী তরুণ-তরুণীদের অনেক কাজ করা বাকি। শুধু সরকারের কাছে দাবি করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, নিজেদের সক্রিয় হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রক্ষার বাস্তব ক্ষেত্রের অনেকগুলোতে সক্রিয়, শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর আমরা রাজীব, দীপ, অভিজিৎদের খুন হতে দিতে পারি না। খুনীদের আমাদের বন্ধু, সন্তানদের একের পর এক টার্গেট করে খুন করতে দিতে পারি না। তাহলে তো কালকে আরেকজন খুন হবে। সতর্কতা, সচেতনতা, দলে চলাফেরা করা, আশপাশের মানুষের ওপর নজর রাখা, প্রয়োজনে নিরাপদ স্থানে থাকা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রচার কাজ চালাতে হবে। মোটকথা, আমাদের ‘মরা’ চলবে না, মরতে হলে মেরে তবেই মরব। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×