ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৪ মার্চ ২০১৫

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

(৩ মার্চের পর) আমরা সবাই মেঝের সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ড্রাইভার সাহেব সবাইকে শক্ত করে কোন কিছু ধরে বসতে বললেন। আর বললেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন।’ বলেই বাসটাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চললেন। তবুও মনে হচ্ছিল বাসটা যেন ধীরগতিতে চলছে। আমরা মেঝেতে বসে কেউ রড, কেউ সিট ধরে আছি শক্ত করে। মাঝে মধ্যেই ছররা গুলি এসে লাগছে বাসের পেছনে। সবাই জোরে জোরে আল্লাহ, ঈশ্বরকে ডাকছি। যে কোন মুহূর্তে গুলি গাড়ির ভেতরে আমাদের আঘাত করতে পারে। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। বাসটা যে কতক্ষণ ছুটেছে কিছুই বলতে পারব না। শুধু জানি, সারাক্ষণ শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি যেন সবাই আমরা সুস্থ অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। একটা সময় বাসটা আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে থেমে গেল। ড্রাইভার সাহেব বললেন, বাস আর সামনে যাবে না। ‘এখানেই সবাইকে নামতে হবে। এক এক করে সবাই নেমে এলাম বাস থেকে। অল্প একটু হাঁটতেই হাতের বাঁদিকে দেখি একটা পাকা দালানের সামনে একটা বড় এন্টেনা ভেঙ্গে পড়ে আছে। বাবা বললেন, এটা হলো চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন। এখান থেকেই মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি সামনে একটা ব্রিজ। লোকজনের কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম এটা কালুরঘাট ব্রিজ। চকবাজারের মতো এখানেও সবাই প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য তৈরি। বাবা প্যান্টের ওপর লুঙ্গি পরেছিলেন। তা দেখে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সৈনিক বাবাকে হয় লুঙ্গি না হয় প্যান্ট যে কোন একটা পরতে বললেন। না হলে পাকিস্তানীদের সামনে পড়লে ওরা নির্ঘাত সন্দেহ করবে। শুনে বাবা লুঙ্গিটা খুলে ফেললেন। একটু পর কয়েকটা খালি রিক্সা পাওয়া গেল। সবাই রিক্সায় উঠে পড়লাম। আমাদের রিক্সাটা কিছুটা পেছনের দিকে ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর চার-পাঁচজন লোক একেবারে সামনের রিক্সাটাকে জোর করে থামিয়ে রাস্তার একপাশে নিয়ে গেল। তাদের দুয়েকজনের হাতে লাঠি ছিল। ছিনতাইকারীর দল। তারা ব্যাগ-স্যুটকেস ধরে টানাটানি করতে লাগল। বুঝতে পারেনি তারা যে, এসব রিক্সার যাত্রী একই দলের লোক। বাড়িওয়ালা এবং সার্কেল অফিসারের ছেলেরা পেছনের রিক্সা থেকে নেমে ধাওয়া দিতেই ছিনতাইকারীরা দৌড়ে পালাল। বাকি পথটা নির্বিঘেœই যাওয়া হলো। সবাই এসে পৌঁছলাম একটা নদীর ঘাটে। মদুনা ঘাট। অনেক নৌকা সেখানে। কত নৌকা নিয়েছিলাম আমরা ঠিক মনে নেই। নৌকা করে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর এসে পৌঁছলাম গহিরার মাদারসা গ্রামে। বাড়িওয়ালা কাশেম সাহেবের শ্বশুর। ওহ, বলতে ভুলে গেছি, যে নদীটা বেয়ে নৌকা করে আমরা এলাম সেটা হলো হালদা নদী। একেবারে নদীর পাড়েই বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা পুকুর। আমাদের সব পরিবারের জন্য একটা করে ঘর দেয়া হলো। দুপুরের খাবারের আয়োজনও করা হলো ওই বাড়ি থেকে। রাতের খাবারটা কি নিজেরাই করেছিলাম, নাকি ওনারাই করেছিলেন এতদিন পর এখন আর ঠিক মনে নেই। যা হোক, এখানে এসে পৌঁছানোর পর মনে হলো যেন স্বর্গে এসে পৌঁছেছি। একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। সমস্ত ভয়ডর উবে গেল। একই সঙ্গে কাশেম সাহেব এবং ওনার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। পরদিন বাবার সঙ্গে আমি ওখানকার বাজারে গেলাম। সঙ্গে সার্কেল অফিসারের কয়েক ছেলেও ছিল। যতদূর মনে পড়ে বেশ কিছুটা দূরে ছিল বাজারটা। তরিতরকারি, মাছ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে দুপুরের আগে বাড়ি ফিরে এলাম। মা রান্নার আয়োজন শুরু করলেন। ওই বাড়ি থেকে রান্নার হাঁড়ি-পাতিল সব দেয়া হয়েছিল আমাদের। ওনাদের ভালবাসা, আন্তরিকতার কোন তুলনা হয় না। এদিকে, আমরা আসার এক কি দুই দিন পরেই কালুরঘাট ব্রিজের ওখানে বাঙালী সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার সৈনিকদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। আমরা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। মাঝে-মধ্যেই আমাদের সামনের হালদা নদী দিয়ে কখনও পাকিদের লাশ, কখনওবা আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লাশ ভেসে যাচ্ছিল। প্রতিদিনই ভেসে আসা লাশ আমরা দেখতাম হালদায়। একদিন আমরা কয়েক ছেলে একটা নৌকা নিয়ে একটু দূরে, নদীর অন্য পারে একটা ক্ষীরা ক্ষেতে গিয়ে উঠলাম। বিরাট ক্ষেতে অজস্র ক্ষীরা ধরে আছে। আশপাশে কোন লোক নেই। কিন্তু যেটা আমরা কেউই খেয়াল করিনি তা হলো মাঠের একদিকে একটা টং ঘর। যেখানে সাধারণত পাহারাদার থাকে। আমরা মহা আনন্দে পকেট এবং হাতভর্তি করে ক্ষীরা তুলতে শুরু করলাম ক্ষেত থেকে। হঠাৎ টং ঘরের দিক থেকে চিৎকার ভেসে এলো, ‘ওই... ফোয়াক্কল, তোরার বাফের মাল ফাইওস না... (ওই ছেলেরা, তোদের বাপের জিনিস পেয়েছিস এগুলো ?)’ দেখলাম, একটা লোক বিরাট একটা দা হাতে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে আর সমানে চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় গালাগাল করছে। লোকটার গায়ে একটা সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে ভাঁজ করে পরা। ওই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে তো আমাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। আগপাছ না ভেবে সবাই সামনের দিকে জান হাতে নিয়ে দৌড় দিলাম। ভুলেই গেলাম আমাদের নৌকাটা রেখে এসেছি আমাদের পেছনের দিকে, সামনের দিকে নয়। আমরা দৌড়াচ্ছিলাম সোজা নদীর দিকে। নদীটা ক্ষীরা ক্ষেতটাকে অর্ধ চন্দ্রাকারে ঘিরে ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে একজন আরেকজনকে বলছিলাম সবাই আমরা সাঁতরে নদীর ওপারে গিয়ে উঠব। নদীর পাড়ে পৌঁছে দেখি সামনে আমাদের নৌকা। আমাদের এক বন্ধু আমাদের সঙ্গে সামনের দিকে দৌড় না দিয়ে পেছনের দিকে দৌড় দিয়েছিল যেটা আমরা কেউই খেয়াল করিনি। ও দৌড়ে গিয়ে নৌকাটা বেয়ে নিয়ে এসেছিল সামনের দিকে, যেদিকে আমরা বাকি সবাই দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে আমাদের নৌকা দেখে মনে হয়েছিল লটারিতে লাখ টাকা পেয়ে গেছি। চোখের পলকে সবাই নৌকায় উঠে পড়লাম। ওই বন্ধুটি বৈঠা দিয়ে আর আমরা বাকি সবাই দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে পানি টেনে নৌকাটাকে মাঝখানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম। দা হাতে লোকটা পাড়ের কাছে যখন এলো তখন আমরা পাড় থেকে অনেক দূরে। ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো সবার। এদিকে, সমানে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছিল লোকটা। আমরাও মনের আনন্দে হাসছিলাম আর লোকটার দিকে তাকিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছিলাম, যাতে লোকটা আরও রেগে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই আর করার ছিল না তার। কারণ, ততক্ষণে আমরা তার নাগালের বাইরে চলে গেছি। এতক্ষণে আমাদের পকেটের ক্ষীরার কথা মনে পড়ল। পকেট থেকে বের করে নদীর পানিতে ধুয়ে খাওয়া শুরু“ করলাম সবাই। প্রথমটা খেয়ে যখন দ্বিতীয়টা পানিতে ধুচ্ছি দেখি নৌকার পাশ দিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটা লাশ ভেসে যাচ্ছে। উপুড় হয়ে ভাসছে। পচে ফুলে উঠেছে। পায়ের গোড়ালি কাক-শকুনে খেয়ে গর্ত করে ফেলেছে। একটা কাক তখনও এক গোড়ালি ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমাদের পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসতে চাইল। হাতের ক্ষীরাটা পানিতে ছুড়ে ফেলে দিলাম। কেউ কোন কথা বলছিল না। দৃশ্যটা যেন সবাইকে বোবা বানিয়ে দিল। যে বৈঠা বাইছিল সেও চুপচাপ বৈঠা চালাচ্ছিল একমনে। ওইভাবে এক সময় আমরা বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছলাম। ওই ঘটনার পর পার হয়ে গেছে আরও কয়েকদিন। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাবা বলল, ‘আজ হাটে যেতে হবে। শাক-সবজি, মাছ ইত্যাদি রান্নাবান্নার জিনিসপত্র কিনতে হবে। কেনী তুইও চল আমার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যাবে কেনাকাটা করতে।’ বাজারের থলে হাতে রওনা হয়ে গেলাম ওই বাড়ির আরও কয়েকজনের সঙ্গে। মনে আছে, বেশ কয়েক মাইল হেঁটেছিলাম হাটে পৌঁছাতে। প্রথমে গ্রামের রাস্তা, তারপর দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে মাটির রাস্তা। কোথাও কোথাও নতুন মাটি ওঠানো কাঁচা সড়ক। যা হোক, হাটে গিয়ে কেনাকাটা শেষ করতে করতে বিকেলটা প্রায় শেষ হয়ে এলো। সঙ্গে চারদিক অন্ধকার করে আকাশটাও আস্তে আস্তে মেঘে ভরে গেল। আমরা সবাই বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেলাম। সঙ্গে আশপাশের অন্যান্য গ্রামের কিছু মানুষ। কিছুদূর যেতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সবাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। দু’পাশে শুধুই ধানক্ষেত। মাঝখান দিয়ে নয়া মাটির রাস্তা। আশপাশে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন ঘরবাড়ি নেই। বৃষ্টিতে মাটির রাস্তা ভয়ানক পিচ্ছিল। পা টিপে টিপে খুব সাবধানে হাঁটছিলাম সকলে। এদিকে সন্ধ্যাও প্রায় নামি নামি করছে। এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর পথের পাশে টিন আর বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। আমাদের সঙ্গের সবাই ওই দোকানে ঢুকে পড়ল বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে। কিন্তু বাবা আর আমি না থেমে চলতে লাগলাম বাকি সবার নিষেধ না শুনে। দোকান ছাড়িয়ে বড়জোর শ’দুয়েক কি শ’তিনেক গজ গিয়েছি, অমনি প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। আমার মনে হলো চারদিক গোলাপি আলোয় ভরে গেল। বাবা আর আমি দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। সম্বিত ফিরল কয়েকজন মানুষের ঝাঁকুনিতে। চেয়ে দেখি আমাদের চারপাশে চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়া সবাই। তাদেরই কয়েকজন বাবা আর আমাকে বাহু ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, ‘আপনারা ঠিক আছেন তো?’ তাঁদের কাছেই শুনলাম আমরা দু’জন নাকি বাজ পড়ার পর কয়েক মিনিট মূর্তির মতো ঠায় দঁাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন নড়াচড়া নাকি করিনি। সবাই ভেবেছিল আমরা মারা গেছি। (চলবে)
×