কাওসার রহমান ॥ ব্যবায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) নির্বাচন অবশেষে মাঠে গড়াচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের এই ভোটযুদ্ধে সেই পুরনো চেহারাই ঘুরেফিরে আসছে। এবারের নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী বিশিষ্ট শিল্পপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ। ইতোমধ্যে তিনি চট্টগ্রাম থেকে তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেছেন। তার প্রতিপক্ষ হিসাবে আছেন বর্তমান প্রথম সহ-সভাপতি ও চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী। সরকারের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও রবিবার এফবিসিসিআইয়ে এসে ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচনে তিনিও সভাপতি প্রার্থী। সত্বরই তার প্যানেল ঘোষণা করবেন।
দুই দফা সময় বৃদ্ধির পর আগামী ২৩ মে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত বছরের নবেম্বরে বর্তমান পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ দুই দফায় তিন মাস করে আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে বর্তমান কমিটি ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সময় পায়। এ বাড়তি সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ সম্প্রতি নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে। নির্বাচনী বোর্ড গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে মিলিত হয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে।
আসন্ন নির্বাচনে সভাপতি পদে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ। বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বার আওলিয়ার পুণ্যভূমি ও দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে তার প্রচার কাজ শুরু করেছেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আগ্রাবাদের হোটেলের ইছামতি হলে শতাধিক চেম্বার ও এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রচার কার্যক্রমের সূচনা করেন তিনি। এ সময় তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনাসহ ব্যবসায়ীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেও এখনও প্যানেল ঘোষণার প্রস্তুতি নেননি আবদুল মাতলুব আহমেদ। তার ঘনিষ্ঠদের সূত্রে জানা গেছে, তার প্যানেল ঘোষণা দেরি হবে। কারণ বর্তমানে তাকে ঘিরে আছে সরকার বিরোধী ব্যবসায়ী গ্রুপের সদস্যরা। সরকারের নেক নজরে থাকায় তার প্যানেল থেকেই তারা এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। যেমনটি ছিল বর্তমান সভাপতির সময়ে। যে কারণে নির্বাচনের পর প্রথম বোর্ড মিটিং করতে তার প্রায় ৫ মাস সময় লেগেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মাতলুব আহমাদ সময় নিয়ে তার প্যানেল ঘোষণা করতে চাইছেন। তবে প্যানেল ঘোষণা বিলম্বে বিএনপিপন্থী প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে তিনি নতুন পুরনো মিলিয়ে একটি প্যানেল করতে চাইছেন। যেখানে নতুনদের প্রাধান্য থাকবে। সেক্ষেত্রে তার প্যানেলটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিশ্র প্যানেল হতে পারে।
অন্যদিকে, মনোয়ারা হাকিম আলী রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমদের সঙ্গে সাক্ষাত করে এসে ফেডারেশন ভবনে সভাপতি পদে তার প্রার্থিতা ও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেন। ঘোষণায় তিনি জানান যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্যানেল দেবেন এবং খুব সত্বরই তার প্যানেল ঘোষণা করবেন। তার প্যানেলেও নতুন ও পুরনোরা সমানভাবে থাকবেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, ‘আমি শুধু পরিচালক হওয়ার জন্য নির্বাচন করব না। সভাপতি হওয়ার জন্যই নির্বাচন করব। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত করব।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এদেশের নারী জাগরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। তিনি এদেশের নারীর উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করছি, তিনি আমাকে উৎসাহিত করবেন।’ নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী, ২০১৫-১৭ মেয়াদের জন্য এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবেন চেম্বার গ্রুপ থেকে। আর প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবে এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে। ফলে সভাপতি প্রার্থী হিসাবে মনোয়ারা হাকিম আলীর কোন সমস্যা নেই। কারণ তিনি চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাছাড়া বর্তমানে তিনি-ই চেম্বার গ্রুপের সংগঠন চেম্বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
তবে চেম্বার গ্রুপ থেকে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সমস্যায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের পছন্দের শীর্ষে থাকা প্রার্থী আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি মূলত এ্যাসোসিয়ের গ্রুপের প্রতিনিধি এবং ইন্দো-বাংলা চেম্বারের সাবেক এই সভাপতি তিনি এখন পর্যন্ত কোন চেম্বারের প্রতিনিধিত্ব পাননি। আর কোন চেম্বারের সদস্যপদ ও মনোনয়ন না পেলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তাই তিনি বিভাগীয় চেম্বারগুলোর কোন একটি থেকে সদস্য হয়ে সেখান থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। কারণ বিভাগীয় চেম্বারের সদস্য হলে বিনা নির্বাচনে সরাসরি এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হতে পারবেন। আর এতে তার সভাপতি হওয়ার পথ সুগম হবে।
প্রথম শোনা গিয়েছিল, তিনি বরিশাল চেম্বারের সদস্য হিসেবে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত বরিশাল চেম্বারে ২৪ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে আবদুল মাতলুব আহমাদের নাম নেই। একই সঙ্গে তিনি সিলেট চেম্বারের সদস্য হওয়ার জন্য লবিং চালাচ্ছেন। তবে এই দুটি বিভাগীয় চেম্বার এখন পর্যন্ত তাকে সদস্য ও মনোনয়ন প্রদানের ব্যাপারে রাজি হয়নি। এজন্য তিনি সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীরও দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত এই দুই মন্ত্রীর যে কোন এক জনের হস্তক্ষেপে দুই চেম্বারের যে কোন একটি থেকে তিনি চড়া দামে সদস্যপদ কিনে নিতে পারেন এমনটাই জানা গেছে।
অবশ্য বর্তমান প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচনে প্রার্থিতার ঘোষণা দিলেও সরকারের নেক নজরে থাকা আবদুল মাতলুব আহমাদকে ঘিরেই এবারের নির্বাচনের সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত মাতলুব আহমাদের একটি বৈঠক থেকেই নির্বাচনের দিন তারিখ ঠিক করে দেয়া হয়। ওই বৈঠকে অবশ্য মনোয়ারা হাকিম আলী এবং নির্বাচনী বোর্ডের প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী নেতা এবং জেলা ও বিভাগীয় চেম্বারের প্রতিনিধিরা। ওই বৈঠকেই বলা হয়, নির্বাচন কোন অবস্থাতেই পেছানো যাবে না।
এফবিসিসিআইয়ের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন (২০১৫-১৭) আগামী ২৩ মে অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল অনুযায়ী বকেয়া চাঁদা আদায়ের তারিখ ২৪ মার্চ ধার্য করা হয়েছে। সংস্থা থেকে প্রতিনিধি/ভোটার মনোনয়নের সর্বশেষ তারিখ ২৫ মার্চ। প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ মার্চ। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৯ এপ্রিল। পরিচালক পদে প্রার্থিতা দাখিলের তারিখ ১৯ এপ্রিল। আর পরিচালক পদে নির্বাচন ২৩ মে। সভাপতি, প্রথম সহ-সভাপতি এবং সহ-সভাপতি পদে নির্বাচন ২৫ মে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত পরিচালকদের মধ্য থেকেই সভাপতি, প্রথম সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন করা হবে।
এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী, একটি পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ হবে দুই বছর। অর্থাৎ প্রতি দুই বছর পর পর এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চেম্বার গ্রুপ থেকে ১৫ জন এবং এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৫ জন মোট ৩০ জন পরিচালক নিয়ে গঠিত হবে পরিচালনা পর্ষদ।
আর সংগঠনের সভাপতি, প্রথম সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী, এক মেয়াদে সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবেন চেম্বার গ্রুপ থেকে এবং প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবে এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে। পরের মেয়াদে সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবেন এ্যাসোসিয়েশন থেকে এবং প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবে চেম্বার থেকে। অর্থাৎ একবার চেম্বার থেকে সভাপতি নির্বাচিত হলে তার পরের বার সভাপতি নির্বাচিত হবেন এ্যাসোসিয়েশন থেকে। এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে সভাপতি নির্বাচিত হন। সে হিসেবে এবার সভাপতি নির্বাচিত হবেন চেম্বার গ্রুপ থেকে।
এফবিসিসিআই সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ১৯৯৪-এর ১৪ (১) ধারা অনুযায়ী নির্বাচনের ৯০ দিন আগে নির্বাচন বোর্ড ও নির্বাচন আপিল বোর্ড গঠন করতে হয়। গঠিত নির্বাচন বোর্ড বাণিজ্য সংগঠন বিধিমাল ১৯৯৪-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী নির্বাচনের ৮০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করবে। সে অনুযায়ী নির্বাচন বোর্ড ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার বিধান রয়েছে।
সূত্রটি জানায়, বিধান মোতাবেক ২৮ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা করা হলেও মে মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় আছে। কারণ বর্তমান বোর্ডের ক্ষমতাসীন একটি অংশ জুলাইয়ের আগে নির্বাচন না দেয়ার পক্ষে। এই অংশটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর নির্বাচন দেয়ার পক্ষে। আবার এপ্রিল-মে মাসজুড়ে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একই সময়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও এরপর রমজান মাস শুরু হবে। আবার বেশ কয়েকটি জেলা চেম্বারের পক্ষ থেকেও নির্বাচন পেছানোর জন্য নির্বাচনী বোর্ডের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: