ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেনী কুইয়া

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৩ মার্চ ২০১৫

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

(২ মার্চের পর) মা আমার ছোট ভাই চার্লসকে দোতলায় পাঠাল বাবাকে ডেকে আনতে। চার্লসের কাছে মিলিটারির কথা শুনে বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সবাইও নেমে এলেন আমাদের বসার ঘরে। সবাই আমার কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলেন। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলেন। কাশেম সাহেবের বন্ধুদের একজন কাশেম সাহেবকে বললেন, ‘এঁদের (আমাদের) আজ পাশের ফ্ল্যাটে রাখেন। বলা যায় না পাকিস্তানীরা রাতে আবারও আসতে পারে। কোন রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।’ পাশের শেষ মাথার ফ্ল্যাটে থাকতেন যতীন বাবুরা। ওনারা আগেই দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন বলে তাদের ঘরটা খালি পড়ে ছিল। অনেক আলোচনা করে আরও একটা সিদ্ধান্ত নিল সবাই যে, এখানে আর থাকাটা ঠিক হবে না। কাল সকালেই গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হবে সবাইকে। যেহেতু আমাদের দাদার বাড়ি (মীরেরসরাই) বা নানার বাড়ি (নোয়াখালী) যাওয়ার পথ বন্ধ, তাই ঠিক হলো আমরাও কাশেম সাহেবদের সঙ্গে যাব ওনার শ্বশুরবাড়ি গহিরার মাদারসা গ্রামে। সার্কেল অফিসারের পরিবারও যাবে আমাদের সঙ্গে। ওনাদের অবস্থাও আমাদের মতো ছিল। খুব সম্ভবত উত্তর বঙ্গের ছিলেন উনারা। সার্কেল অফিসারের ছিল চার ছেলে, সবাই কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। ওই সময় কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের নিয়েই বাবা-মায়েরা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। যা হোক, ঠিক হলো কাল যত সকাল সকাল সম্ভব রওনা হয়ে যাব আমরা। রাতটা কাটালাম আমরা যতীন বাবুদের ঘরে। পরদিন সকাল আনুমানিক ৮-৯টার দিকে আমরা সবাই রওনা হয়ে গেলাম গহিরার উদ্দেশে। কাশেম সাহেবের বন্দুক দুটো ওনার স্ত্রীর শরীরের দুই পাশে বেঁধে নেয়া হলো। তার ওপর তিনি বোরকা পরে নিলেন। আমাদের ঘর থেকে গলির দূরত্ব দুই শ’ ফুটের মতো। ডিসি হিলের ওপরে পাহারারত সেন্ট্রির চোখ এড়িয়ে গলি পর্যন্ত যাওয়াটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল আমাদের জন্য। তার ওপর আবার সবার হাতেও বাক্স-পেটরা জাতীয় কিছু না কিছু ছিল। কাশেম সাহেবের ঘরগুলো সামনাসামনি দুই সারিতে। আমরা একজন একজন করে সেন্ট্রির চোখ এড়িয়ে আমাদের সামনের সারির ঘরের আড়ালে চলে এলাম। ওখান থেকে সোজা দুই শ’ ফুট সামনে আমাদের পাড়ার গলি। প্রথম এক শ’ ফুটে কোন আড়াল নেই, একেবারে ফাঁকা জায়গার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তারপরের এক শ’ ফুটে আবার আরেকটা বাড়ির আড়াল আছে। ঠিক হলো একজন একজন করে ফাঁকা জায়গাটা পার হব সবাই। উত্তেজনায়, ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকের ভেতর থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। এই অবস্থায় কিছুক্ষণ পর পর সেন্ট্রিটা একটু অন্যদিকে গেলে আমরা একজন একজন করে খুব সাবধানে ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে গলির কিনারে গিয়ে উঠলাম। গলিটা সোজা চলে গেছে ডিসি হিলের দিকে। ডিসি হিলের ঠিক নিচেই বড় রাস্তা। গলিটাও কিন্তু পরিষ্কার দেখা যায় পাহাড়ের ওপর থেকে। একই কায়দায় একজন একজন করে গলিটা আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে ওপাশের বাড়িগুলোর আড়ালে ঢুকে পড়লাম সবাই। এতটুকু এসে সবাই আমরা যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই বাড়িগুলোর ভেতরটা আবার পাহাড়ের ওপরের সেন্ট্রির চোখের আড়ালে। তবুও আমরা খুব সাবধানে, বিন্দুমাত্র শব্দ না করে বাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে জামালখান রোডে এসে উঠলাম। চারদিকে তাকিয়ে একটা মানুষের ছায়াও দেখা গেল না। প্রচণ্ড আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। যে কোন সময় যে কোন দিক দিয়ে পাকিস্তানী হানাদাররা এসে হাজির হতে পারে। সামনে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। ওখানেই সবাইকে শেষ করে দেবে। কাশেম সাহেব প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘সবাই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটেন। বেশ কয়েক মাইল হাঁটতে হবে, চকবাজার পর্যন্ত। ওই এলাকাটা এখনও বাঙালীদের দখলে আছে। ওখানে পৌঁছে দেখা যাক একটা গাড়ি-টাড়ির ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তা না হলে আরও অনেকদূর হাঁটতে হবে।’ বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ঢিপঢিপ করছিল যে, মনে হচ্ছিল আশপাশের সবাই সেটা শুনতে পাচ্ছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে আমরা জামালখান রোডের ওপর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব পেরিয়ে এলাম। একটু এগোতেই জামালখান গির্জার সামনে গোলচক্করে এসে পড়লাম। বাঁদিকের রাস্তাটা চলে গেছে আশকার দিঘির পাড়ের দিকে। ডানদিকেরটা গির্জার পাশ ঘেঁষে প্যারেড গ্রাউন্ড হয়ে চকবাজারের দিকে চলে গেছে। আমরা প্রায় দৌড়ে গোলচক্করটা পার হয়ে গির্জার সামনের ফুটপাথে এসে উঠলাম। গির্জার সীমানা প্রাচীরঘেঁষা ফুটপাথ দিয়ে আমরা ডানদিকের রাস্তা বরাবর হাঁটতে লাগলাম চকবাজারের উদ্দেশে। এখন পর্যন্ত একটা মানুষও দেখা গেল না। সবাই মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছি সারাক্ষণ। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। চারপাশের পিনপতন নিস্তব্ধতা প্রচণ্ড শক্তিতে যেন আমাদের সবাইকে পিষে ফেলছিল। কয়েক মাইল হাঁটার পর প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পড়লাম। এখনও আরও প্রায় সমপরিমাণ পথ হাঁটতে হবে। যা হোক, অবশেষে নিরাপদে চকবাজার এসে পৌঁছলাম। আমার ছোট ছোট ভাইবোনরাও কোনরকম অভিযোগ বা কান্নাকাটি ছাড়াই নীরবে সমস্ত পথ হেঁটে এসেছে। শুধু সবার ছোট (বোন) শেলী, যার বয়স মাত্র ছয় বছর তখন, কখনও কখনও কোলে তুলে নিতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শেলীও কিন্তু কোন কান্নাকাটি করেনি এতটা পথ হাঁটার সময়। চকবাজারে এসে দেখলাম ইপিআরের সৈনিকদের, সশস্ত্র। সঙ্গে কিছু পুলিশ বাহিনীর সদস্য। মনে হয় কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যও ছিল। সবাই খানিকটা দূরে দূরে বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে আছে। সামনে-পাশে বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কারের মতো করা। চকবাজার থেকে মাইল দুয়েক দূরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ। ওখানে পাকিস্তানী হানাদাররা ঘাঁটি গেড়েছে। যে কোন সময় তারা হামলা করতে পারে। সবার মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এমন সময় কোথা থেকে যেন একটা খালি বাস (মুরির টিন নামেই পরিচিত) এলো। আমরা সবাই উঠে পড়লাম সেই বাসে। সঙ্গে আরও কিছু আমাদেরই মতো মানুষ। বাস যাবে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত। ওখানেই চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন। যেখান থেকে মার্চের ২৭ তারিখে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস ছুটল কালুরঘাটের দিকে। কিছুদূর যেতেই পেছনে চকবাজারের দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। ক্রমশ গোলাগুলি প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হয়ে উঠল। বাবা, আমি এবং আরও কয়েকজন আমরা একেবারে পেছনের লম্বা সিটটায় বসেছিলাম। হঠাৎ ছরর করে কিছু ছররা গুলি এসে আমাদের বাসের পেছনে আঘাত করল। ড্রাইভার আর হেলপার চিৎকার করে বলে উঠল, ‘অনেরা ব্যাকে সামনের দিকে ফোলরে নামিয়েরে বই ফরন (আপনারা সবাই সামনের দিকে ফ্লোরে নেমে বসে পড়ুন)’। (চলবে)
×