ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহেশখালীর ৩ রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ॥ আটক ২

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২ মার্চ ২০১৫

মহেশখালীর ৩ রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ॥ আটক ২

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর তিন রাজাকার সালামতউল্লাহ খান, মৌলভী জাকারিয়া সিকদার ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়ার (বিএ) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ১৮ মার্চের মধ্যে অগ্রবর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। এদিকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসামি সালামতউল্লাহ খান, মোহাম্মদ রশিদ মিয়াকে গ্রেফতার করেছে মহেশখালী পুলিশ। ট্রাইব্যুনালে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের আবেদন জানান প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। এই তিন রাজাকার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ, হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোরী অপরাধ করেছেন। মহেশখালী থানায় বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ী এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নিয়ে গিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীতে আশ্রয় নেয়া অগণিত লোককে হত্যা করে। এছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করে তারা তা মসজিদে রূপান্তর করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত লোকজনদের সেখানে নামাজ পড়তে বাধ্য করে। যে সমস্ত হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য খৎনা করানো হয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত প্রতিপক্ষরা এলাকার অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায়। অনেক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করতে বাধ্য করে। অভিযুক্ত প্রতিপক্ষ মৌলভী জাকারিয়া সিকদার নিজেই পুলিন বিহারী পালের কন্যা শিখা রানীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করে। এমনকি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য করে এই আসামি। এই তিন আসামি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমর্থক, সংগঠকসহ সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য বর্তমান কক্সবাজার জেলাধীন মহেশখালী থানা এলাকায় সকল প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। একাত্তরের ৩০ এপ্রিল মহেশখালী থানা শান্তি কমিটি গঠন করে। ওইদিন দুষ্কর্মের সহচরদের নিয়ে মহেশখালী থানার কালারমারছড়া বাজারে বাদ মাগরিব ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কথিত শান্তির লক্ষ্যে একটি শান্তি মিটিংয়ের আয়োজন করে। শান্তি মিটিংয়ে স্থানীয় কালারমারছড়ার ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোঃ শরীফ আহমদকে চাতুরির আশ্রয় নিয়ে সভাপতি করে অভিযুক্ত তিন জনের যোগসাজশে কথিত সভা শুরু করে। তাদের গোপন ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তৎকালীন মহেশখালী থানার ওসি শামসুল হকের নেতৃত্বে এক দল সশস্ত্র পুলিশ ওইদিন রাত আনুমানিক আটটার দিকে কালারমারছড়া বাজারে অনুষ্ঠিত কথিত শান্তির মিটিংস্থলে উপস্থিত হয়। ওই সময় কথিত শান্তির মিটিংয়ে উপস্থিত শান্তি কমিটির লোকজন পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ‘পাঞ্জাবি এসেছে, পাঞ্জাবি এসেছে’ বলে হৈ-হুল্লা শুরু করে। তাদের ওই হৈ-হুল্লায় আতঙ্কিত হয়ে সভায় উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক লোকজনরা প্রাণভয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ওই মুহূর্তে অভিযুক্ত প্রতিপক্ষ সালামতউল্লাহ খান ও মৌলভী জাকারিয়া সিকদারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মহেশখালী থানার তৎকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি, শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিযুক্ত মোহাম্মদ রশিদ মিয়া বিএ তার হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে শরীফ আহমদ চেয়ারম্যানকে গুলি করে। একই সঙ্গে মহেশখালী থানার তৎকালীন ওসি শামসুল হক নিজের পিস্তল দিয়ে একই কায়দায় শরীফ চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে গুলি করে। একাত্তরের ৩ মে সকাল আনুমানিক এগারোটার দিকে কালারমারছড়া ইউনিয়ন অফিসের সামনে থেকে জানে খুন করায় বদমতলবে তাদের আটক করা হয়। ৬ মে বিকেল আনুমানিক ৫-৫.৩০টার দিকে আটককৃতদের হাত, চোখ বেঁধে কক্সবাজার আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে আটককৃত শফিকুর রহমান ও ইউনুচকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একাত্তরের ৫ মে দুপুর বেলা দখলদার পাকিস্তানী আর্মি কক্সবাজারে সদরে আগমন করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ খবর পেয়ে ওইদিনই অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ তাদের ঘনিষ্ঠ সহচর দুষ্কর্মের সহযোগী শান্তি কমিটির ও নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী লোকজনদের নিয়ে মহেশখালী থানা এলাকা থেকে নৌকাযোগে কক্সবাজার সদরে এসে পাকিস্তানী পতাকা হাতে মিছিল সহকারে দখলদার পাকিস্তানী আর্মির ক্যাম্পের গিয়ে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মহেশখালী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে এর পরের দিন অর্থাৎ ৬ মে সকাল ১০টার দিকে দখলদার পাকিস্তানী আর্মির শতাধিক সদস্য ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত দ্বীপাঞ্চল মহেশখালী থানাধীন গোরকঘাটা জেটিঘাটে আসে। তারা একযোগে গোরকঘাটা বাজার এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীদের দোকানপাটে ব্যাপক লুটপাট চালায়, অনেককে হত্যা করে। উক্ত রূপে বাজার এলাকায় লুটপাট ও গণহত্যা সংঘটিত করার পর অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুষ্কর্মের সহচরদের বিভিন্ন দলে ও গ্রুপে ভাগ করে এবং নিজেরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়ে মহেশখালী থানাধীন বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ী এলাকায় আর্মিদের নিয়ে গিয়ে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় আশ্রিত অগণিত লোককে হত্যা করে গণহত্যা চালায়।
×