ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হিটলিস্টে আরও ৯ জন ॥ নিষিদ্ধ হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২ মার্চ ২০১৫

হিটলিস্টে আরও ৯ জন ॥ নিষিদ্ধ হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম

শংকর কুমার দে ॥ উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে (এবিটি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। ‘সিরিয়াল কিলিং’ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। ‘সিøপার সেল’ ও ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে খুন করে এই সংগঠনের জঙ্গীরা। এই সংগঠনের হিটলিস্টে আছে প্রায় এক ডজন ব্লগার, লেখক, বুদ্ধিজীবী। যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ফেসবুক, টুইটারে, ব্লগে লেখালেখি করেন এমন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন তাদের টার্গেট। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এই সংগঠনটির। মুক্তমনার ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একের পর এক সিরিয়াল কিলিং করে যাওয়ার প্রতিবেদন জমা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজীব, ইমাম মাহাদীর কথিত সেনাপতি লুৎফর রহমান, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ও বুয়েটের ছাত্র দীপকে হত্যা করে এই জঙ্গী সংগঠনটিই। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০১৩ সালে। তারপর একের পর এক খুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যাচ্ছে এই জঙ্গী সংগঠনটি। কখনও আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ, আবার কখনও আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে হত্যার দায় স্বীকার করছে তারা। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহ্রীর, ইসলামিক স্টেটসহ অন্য উগ্রপন্থী জঙ্গীরা একই সূত্রে গাঁথা, মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। একটি জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলে সেই জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা অন্য নামের জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতে থাকে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কাজের ধরনও প্রায় একই। ২০১৩ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) প্রতিষ্ঠাতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীকে গ্রেফতারের পর এখনও কারাগারে আছেন তিনি। কারাগারের ভেতর থেকেই জঙ্গী সংগঠনটির পরিচালনা ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। জসিমউদ্দিন রাহমানী ২০১৩ সালে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে থাকলেও তার বয়ানের ভিডিও ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইনে ভাসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর টুইটার বার্তায় হত্যার দায় স্বীকার করা হয় আনসার বাংলা-৭ নামে। এই হত্যাকা-ের ঘটনার পর সরকারের ওপরের পর্যায়ে টনক নড়ে ওঠে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জঙ্গী সংগঠন শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকত-উল-জিহাদ (হুজি), জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশকে (জেএমজেবি)। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহ্্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অথচ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার ও আশরাফুল আলমকে হত্যা, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন এবং রাকীব মামুনের ওপর হামলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত আছে। ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করার পর সরকার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমটি গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার আদর্শের অনুসারী হয়ে তারই আদলে। ২০১০ সালে ইয়েমেনে আল কায়দাবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় এফবিআইয়ের তালিকাভুক্ত জঙ্গী মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম ও রেজওয়ান শরীফ। পশ্চিমা গোয়েন্দারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পর তারা একই কর্মকা- চালাতে থাকে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারের বিমান উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে তেহজীব করিমের ভাই রাজীব করিমকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয় তাকে। অপর জঙ্গী সংগঠন জেএমবির শুরুর দিকে যুক্ত ছিলেন রাজীব করিম। ২০১৩ সালে গোয়েন্দা পুলিশ এবিটির যে ক’জনকে গ্রেফতার করেছিল রেজওয়ান শরীফ তাদের অন্যতম। গ্রেফতারকৃত রেজওয়ান শরীফ জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ইয়েমেনেও গ্রেফতার হয়। পাকিস্তানে পলাতক জঙ্গী ইজাজ হোসেন ও আত্মগোপনে থাকা রেজওয়ানুল আজাদ রানা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশনের দায়িত্বে রয়েছে। নাইমুল হাসান পাকিস্তানে পলাতক জঙ্গী ইজাজ হোসেনের ভাই। ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হয়ে ২০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত রাজীব শরীফ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তারা সবাই মুফতি জসিমের শিষ্য ছিল। এই জঙ্গি সংগঠনটি তাদের হিটলিস্টে আছে যারা তাদেরকে ‘সিøপার সেল’ ও ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে খুন করে। খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতাদের আড়ালে রাখতেই এই ধরনের পদ্ধতির আশ্রয় নেয় তারা। খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত কিলার গ্রুপের কোনো সদস্য ধরা পড়লেও তাদের বাইরে অন্য কারও নাম-ধাম জানতে পারবে না। প্রায় ৩ থেকে ৭ জনকে দিয়ে এ সিøপার সেল তৈরি করা হয়। এক সেলের খবর আরেক সেল কখনই জানতে পারে না। সিøপার সেলের সদস্যরা কোন ব্যক্তিকে হামলার টার্গেট করলে প্রথমে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। এ পদ্ধতিতেই বগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। সিøপার সেল ও কাট-আউট পদ্ধতির অন্যতম সদস্য রেজাওয়ানুল আজাদ রানা। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজওয়ানুল আজাদ রানার নাম আসে। তাকেও অভিজিৎ রায় হত্যাকা-ের অভিযোগে গ্রেফতারের জন্য খোঁজ করা হচ্ছে। অভিজিৎ রায় হত্যাকা-ে সিøপার সেল ও কাট-আউট পদ্ধতি ব্যবহার করে খুন করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হিটলিস্টে আছেন প্রায় এক ডজন ব্লগার, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। এর মধ্যে গত দুই বছরে হিটলিস্টের তালিকা ধরে তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে। আরও যারা হিটলিস্টে আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে গ্রেফতার হওয়া ব্লগার রাসেল পারভেজ, সুব্রত অধিকারী শুভ, আসিফ মহিউদ্দিন মশিউর রহমান বিপ্লব অন্যতম। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গীদের দাবি, বিভিন্ন নামের ব্লগের মাধ্যমে ইসলাম ও ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি, ব্যঙ্গচিত্র ও অশালীন বক্তব্য প্রচার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রচ- আঘাত করায় টার্গেট করা হয়েছে তাদের। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের যেসব জঙ্গী বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে জামিনে মুক্ত হওয়ার আগে গোয়েন্দাদের কাছে জবানবন্দী দিয়েছে তাতে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে এলিফ্যান্ট রোডে কুপিয়ে জখম করে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাকীব আল মামুনকে। ওই বছর আগস্টে বুয়েটের আরেক ছাত্র তন্ময় আহমেদ ও গত বছর ব্লগার সানিউর রহমানকে জখম করা হয়। এবিটির হত্যার তালিকায় রয়েছে তারাও। হিটলিস্টের তালিকায় থাকা ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কেও তারাই হত্যা করেছে বলে দায় স্বীকার করেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
×