ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২ মার্চ ২০১৫

চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে

বাংলাদেশে জঙ্গীদের তৎপরতা নতুন কোন ঘটনা নয়। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গীবাদের নতুন ছক গড়ে ওঠায় বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে এখানকার জঙ্গীরা নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। ভারতের জঙ্গীদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গীদের সম্পর্ক অনেক পাকাপোক্ত। ‘অপারেশন’ চালিয়ে তারা দ্রুত এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়। ফলে ধরা পড়ে না। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও যুক্তরাষ্ট্রের আইএসবিরোধী যুদ্ধে জড়ায়নি বাংলাদেশ। তাই দেখা যায় জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশন চলাকালেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশকে আইএসবিরোধী জোটে যোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত বৈঠকে যোগ দেয়নি তখন। তবে বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছিল জঙ্গীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। জঙ্গীবাদের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। সন্ত্রাস বিস্তারই তাদের কাজ। জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত একটি শব্দ। মড়কের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে। এ সংক্রামক ব্যাধি থেকে বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সন্ত্রাসবাদের বা জঙ্গীবাদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা পঁচাত্তর-পরবর্তী পুনরুত্থানের মধ্যেই জঙ্গীবাদের জন্ম। জঙ্গীবাদ কেবলই এক নীতিহীন গণধ্বংসী কাজের নামান্তর। সুস্থ সবল সুখী জীবন যে কোন সময়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে পেট্রোলবোমা, গ্রেনেড বা ধারালো কৃপাণে। জঙ্গীবাদীরা প্রতিটি অপকর্মের পরও বুক ফুলিয়ে হাঁটে বীরের বেশে। জঙ্গীরা বারবার বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে। একটা ঘটনা ঘটার পর ধরপাকড় শুরু হয়, কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ পেয়েও যায় কোন না কোন সূত্র। কিন্তু বিস্ফোরণ বা হামলার আগে কিছুতেই জঙ্গীবাদীদের মগজের হদিস পায় না গোয়েন্দা বা পুলিশ বাহিনী বা র‌্যাব। এ যেন এক মজার ধাঁধা। আর এই ধাঁধার চক্করেই নিষ্প্রাণ হয়ে যায় নিরীহ বহু প্রাণ। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদ পরস্পরের পরিপূরক। এদের নিজস্ব কোন আদর্শ নেই। তাদের একটাই লক্ষ্যÑ দেশের স্থিতিশীল অবস্থাকে তছনছ করা। সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা। সন্ত্রাসের কাছে যেন নিরুপায় প্রশাসন এবং জনগণ। জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদ এমন একটা ‘বাদ’ যেখানে কিছু মানুষের অন্যায় আবদার আদায়ের জন্য, সরকারকে জব্দ করার জন্য সাধারণ নিরপরাধ মানুষের জীবন এবং জাতীয় সম্পদকে প্রধান লক্ষ্য করে। মাকড়সার জালের মতো বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ আজ সীমাহীন। কোন প্রতিবাদ, কোন শুভবুদ্ধি তাকে বদলাতে পারছে না। পারবে কি বাংলাদেশ এই জঙ্গীবাদকে নির্মূল করতে, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়, এমনকি অতীতে সরকারের প্রশ্রয়ে এ দেশে জঙ্গীবাদের বিকাশ ঘটেছে। আর এখন তো বিএনপি-জামায়াত জোট বোমা সন্ত্রাস অব্যাহত রেখে ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যা করে চলছে। জঙ্গীবাদ আন্তর্জাতিক রূপ নেয়ার পর এক দেশের ভূখ- ব্যবহার করে অন্য দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর কৌশলকে জঙ্গীরা সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয়। তবে জঙ্গীরা যে দেশের ভূখ- ব্যবহার করে তাদের তৎপরতা চালায়, সে দেশের ভূমিকার বিষয়টি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এ ধরনের কাজে তার ভূখ- ব্যবহার করতে দিতে পারে না। জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। যখন আফগানিস্তান তথাকথিত মুজাহিদদের দখলে চলে যায়। এরপর ১৯৯২ সালে জঙ্গীদের প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ এই বাংলাদেশে হয়েছে। মৌলবাদী ইসলামিক দল থেকে সেøাগান তোলা হয়েছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ নব্বইয়ের দশকেই আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই হাজার পাঁচশ’ মুজাহিদ অংশ নিয়েছিল। এরা সবাই জামায়াতসহ ইসলাম নামধারী দলগুলোর সদস্য। এদের মধ্যে ৩০/৩৫ জন ছিল গ্রেনেড নিক্ষেপে পারদর্শী। এই গ্রেনেড বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ আফগান মুজাহিদ নেতা বোরহানউদ্দিন রব্বানী ও অপর অংশ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেয়। এদের মধ্যে তিনজন আফগান যুদ্ধে মারা যায়। জীবিত গ্রেনেড বিশেষজ্ঞরা ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে আসে। পাকিস্তানের করাচী, ইসলামাবাদ, রাওয়ালপি-িতে এই মুজাহিদদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একই সঙ্গে গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ দিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ থেকে যেসব মাদ্রাসা ছাত্র আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তানে যেত, তাদের অধিকাংশই পড়াশোনা করত ইসলামাবাদের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসায় সরাসরি জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গী পরবর্তী সময়ে সীমান্তে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিত। এই গেরিলা প্রশিক্ষণে তারা রিপেয়ারিং, অস্ত্র চালনা, ভূ-মাইন স্থাপন, রকেট লঞ্চার চালনা, গ্রেনেড ছুড়ে মারা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি আফগানিস্তানে প্রবেশ করত। ১৯৮৮ থেকে ৯০ পর্যন্ত যে কয়জন মুজাহিদ রকেট লঞ্চার চালনা ও গ্রেনেড ছোড়ায় বিশেষ প্রশিক্ষণে পরদর্শী হয়ে ওঠে তারা দেশে ফিরে গ্রেনেড হামলা চালায় বিভিন্ন সময়। যেমনÑ মাওলানা হাবিবুর রহমান, মুফতি হান্নান, আবু সুফিয়ান, মুফতি শহীদুল ইসলাম, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আবদুর রউফ প্রমুখ। ১৭ ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দেশজুড়ে বোমাবাজি, গোপালগঞ্জের ঘটনায় এরা জড়িত ছিল। এর মধ্যে মুফতি হান্নান জেলে। বাংলাভাই বিচার শেষে ফাঁসিতে ঝুলেছে। স্মরণ করা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের জামিয়া-ইমদাদিয়া মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আতাউর রহমান খান (যিনি পরে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হন) ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে হরকাতুল জিহাদের আমন্ত্রণে পাকিস্তানে যান। সেখানে তাঁদের সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের দেখা হয়। পরবর্তীকালে তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগান যুদ্ধে অংশ নেন। সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের প্রধান মাওলানা হাবিবুর রহমান তো স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, ১৯৮৮ সালে হুজির উদ্যোগে প্রথমে পাকিস্তান যান। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ পান। তাঁর জঙ্গী তৎপরতা ছিল সিলেটজুড়ে। আফগান ফেরত হুজির সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশে হুজি জন্ম নেয় ১৯৯২ সালে। এই দলের ব্যানারেই প্রথম সশস্ত্র জঙ্গী তৎপরতা শুরু হয়। মুফতি হান্নানরা সশস্ত্র পন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও রাবেতা আলম আল ইসলামী, আর হারমাইন, কুয়েতভিত্তিক তাওহীদ ট্রাস্ট তাদের অর্থায়ন করে বলে প্রেফতারের পর মুফতি হান্নান জানিয়েছিল। আফগান ফেরত জঙ্গীদের অনেকেই দেশে ফিরে এসে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। অস্ত্র চালনা ও গ্রেনেড ছোড়ায় এই বিশেষজ্ঞরা দেশীয় মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বিষয়ে পারদর্শী করে তোলে। এসব প্রশিক্ষিত জঙ্গী পরে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়। তারাও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন জঙ্গীদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ রাইফেলসের ‘আর্জেস গ্রেনেড’ও এসব জঙ্গীর হাতে চলে আসে। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হাওয়া ভবনের নির্দেশে ভাড়াটে হিসেবে তারা গ্রেনেড হামলা চালায়। যাতে ২১ জন নিহত ও বহু আহত হয়। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে যান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে জঙ্গীরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করত। এসব জঙ্গীর একটা বড় অংশই ছিল জামায়াতের সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে এদেশে জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ শুরু করে। ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে র‌্যাবের অনুসন্ধানে প্রশিক্ষণ ঘাঁটিগুলো চিহ্নিত করা হয়। দুর্গম পাহাড়ী এলাকাগুলোসহ সীমান্তবর্তী স্থানে এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকার জঙ্গীদের সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলের জঙ্গীদের যোগাযোগ রয়েছে। ২০০৪ সালে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) এবং জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) রাজশাহী ও নওগাঁ এলাকায় অপরাধ দমনের নামে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে হত্যাকা- শুরু করে। ঢাকার দুটি বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক এই তৎপরতাকে গোড়াতে অভিনন্দন জানিয়েছিল। একই বছরের ১৭ মে বাংলাভাই তিন ব্যক্তিকে অপহরণ করে। এর তিনদিন পর একজনকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। ‘জনকণ্ঠ’ সেদিন এদের অপতৎপরতার খবর জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। দেশজুড়ে তা আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকার এই তৎপরতা অস্বীকার করে। ২০০৪ সালের আগস্টে সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাভাইয়ের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। সবই মিডিয়ার সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র। ২০০৫ সালের মার্চে সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ নেত্রী খালেদা জিয়া পুনরায় বলেন, সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্যই বাংলাভাই নামক কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্যই এ ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আরও এক ধাপ এগিয়ে সে সময়ের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সংসদেই বলেছিলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুযোগে একটি সেকশন মানবাধিকার লঙ্ঘন, মৌলবাদীদের উত্থান এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের ব্যাপারে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটি সেকশন সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালাচ্ছে। আর জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামী (খালেদার মন্ত্রিসভার সদস্য) বলেই ফেলেন, বাংলাভাই বলে কিছুই নেই। সবই মিডিয়ার সৃষ্টি। কিন্তু তাদের এসব ভাষ্য যে জঙ্গীদের আড়াল করার জন্য, তা পরে স্পষ্ট হয়। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাই ধরা পড়ে। বিচারে তারাসহ ৬ জনের ফাঁসি হয়। বাংলাদেশে এই প্রথম জঙ্গী নেতাদের শাস্তির ঘটনা ঘটে। এদের ফাঁসির পর জঙ্গীরা তাদের কৌশল বদলায়। বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকার চরাঞ্চলে তারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করে। প্রশিক্ষণের জন্য মাদ্রাসা বাদ দিয়ে গহীন অরণ্য বেছে নেয় আরেক দল জঙ্গী। জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্ত জঙ্গীরা বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছে। কারাগারেও রয়েছে কয়েকজন। গত ৬ বছরেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার সম্পন্ন করা যায়নি। বিচার দীর্ঘ প্রলম্বিত হওয়ার কারণে জঙ্গীদের সাহস ও শক্তি বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে জেএমবি ও হুজি সংগঠন দুটি নিষিদ্ধ করা হয়। এরা নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি হিযবুত তাহরীর নামে আরেকটি জঙ্গী গোষ্ঠী তৎপর হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নেতৃত্বে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর সদস্য। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তাদের গোপন তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। দেয়ালজুড়ে মাঝে মাঝে তাদের পোস্টার দেখা যায়। যেখানে সরকার উৎখাত করার জন্য জেহাদী ভাষ্য থাকে। এই সংগঠনটিতে তরুণ এবং মেধাবী ছাত্ররা কেন জড়িয়ে পড়ছে, তার কোন ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি। দেশে আরও জঙ্গী সংগঠন তৎপর রয়েছে। এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের তৎপরতা চালিয়ে থাকে এলাকাভিত্তিক। হিজবুল মাহদি, শাহাদাৎ আল হিকমা, সাহাবা সৈনিক পরিষদ, আল্লাহর দল, লস্কর-ই-তৈয়বা, আহলে হাদীস, তামির উদ দ্বীন প্রমুখ। সর্বশেষ সংযোজিত হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা-৭। যারা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলাফেরত বিজ্ঞানী লেখক অভিজিৎ রায়কে টিএসসির মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তার স্ত্রীকেও তারা রক্তাক্ত করে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে তারা হত্যা করে। হত্যার পর নিজেরা সেই দায়ও স্বীকার করেছে। জঙ্গীদের ‘অপারেশন’ এতই নিখুঁত যে, গোয়েন্দারাও আগাম টের পায় না। মহাজোট সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি-জামায়াত জোট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাদের সদর্পে অবস্থান এবং জঙ্গীবাদে উৎসাহিত করে প্রচার-প্রচারণা চলছে অবিরাম। এই মাধ্যমগুলোতে তারা জঙ্গী মতবাদকে ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালায়। এমনকি হত্যার হুমকিও দেয়। এসব মনিটরিংয়ের জন্য নিয়োজিত সরকারী সংস্থাগুলোর কোন তৎপরতাই পরিলক্ষিত হয় না। বিপরীতে মহাজোটের কোন নেতা-কর্মী, অনুসারীদের তৎপরতা এসব মাধ্যমে দেখা যায় না। যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁরা রাজনীতির ধারে-কাছেও যান না। মন্ত্রী, নেতারা নিজেদের দাফতরিক ও পারিবারিক চিত্র প্রচারেই ব্যস্ত। তাই দেখা যায়, যখন রাজশাহীতে গত মাসে বাস পোড়ানো হয়, তখন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এলাকায় ক্রিকেট খেলছেন এমন ছবি পোস্ট করেন। বাস পুড়ছে আগুনে অথচ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ব্যস্ত নিজের প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচারণায়। এ এক নির্বিকারত্ব, নির্জীব, নিবীর্য অবস্থায় সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়েছে জঙ্গী সংগঠন জামায়াত, শিবিরসহ সন্ত্রাসীদের যোগাযোগসহ নাশকতা চালানোর সহজ মাধ্যম। শেখ হাসিনার সরকারের কৃতিত্বের সুফল ভোগকারী জঙ্গীরা নিধন করতে চায় শেখ হাসিনাকে, উৎখাত করতে চায় তাঁর সরকারকে। ইতোমধ্যে তারা একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করে গেরিলা কায়দায় হামলা করছে সাধারণ মানুষের ওপর। পেট্রোলবোমা, ককটেল ব্যবহার করছে। তার পাশে এখন অপর অস্ত্র ‘কৃপাণ’ সংযোজিত হয়েছে। এরপর হয়ত আসবে রাইফেল, বন্দুকসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। সাধারণ মানুষ থেকে লেখক হত্যা পর্যন্ত এগিয়েছে, এরপর হয়ত আরও ওপরের দিকে উঠবে। সে লক্ষণ তো শুরু হয়েছে। হত্যা করে পুলিশের নাকের ডগায় বীরদর্পে হেঁটে যাওয়ার মতো শক্তি ইতোমধ্যে সঞ্চার করেছে জঙ্গীরা। এরা বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত জোটের হয়ে ভাড়া খাটছে। লক্ষ্য তাদের যুদ্ধাপরাধীদের কারাগারমুক্ত করা। বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাভাই স্টাইলে দেশের বিভিন্ন স্থান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। এদের অর্থ ও অর্থায়নে আইএসআই এক পায়ে দাঁড়িয়ে। যাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনে বাধ্য করা এবং বাংলাদেশকে আবারও উপনিবেশ গড়া। সেইসঙ্গে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। সংবাদপত্রে প্রায়শই ছাপা হচ্ছে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কারের ঘটনা। কিন্তু এসবের নেপথ্য নায়করা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। জঙ্গীরা ঢাকায় ও ঢাকার চারপাশে গোলাবারুদের সংরক্ষণশালা গড়ে তুলেছে লোকচক্ষু তথা গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে। এমনভাবে কাজ করছে ধরে নিতে হবে চারপাশে ভাল মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। গোয়েন্দারা তা জেনেও না জানার ভান করে বসে আছে। দায়িত্ব পালনে তাদের অবহেলা যে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতির কারণ, তা তারা বুঝতে পারেন না হয়ত। সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি আজিজুর রহমান আজিজ আক্ষেপ করে বললেন, ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে জামায়াত-শিবির, হিযবুত, তালেবান, আল কায়েদা, আনসারুল্লাহ বাংলা-৭ ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তুলেছে তা অনেকেই জানে। কিন্তু কেউ তা উচ্ছেদ করছে না। তিনি এমন তথ্যও দেন যে, জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা লেবাস বদলে সাধারণ মানুষের ভেতরে মিশে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। সরকারী বাহিনীর লোকজনের সঙ্গে সখ্য সৃষ্টি করছে। টোপ দিচ্ছে সময়মতো তারা যাতে নিষ্ক্রিয় থাকে। তারা ভয়াবহ সন্ত্রাস ঘটাবার অপেক্ষায়। চট্টগ্রামে যা উদ্ধার করা হয়েছে তার দশ-বিশগুণ আছে ঢাকার ভেতরে ও চারপাশে। বিষয়টি যদি সত্যি হয় তবে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতে প্রতিটি জঙ্গী হামলার ঘটনা প্রমাণ করে এই সমাজে কেউ নিরাপদ নয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় জঙ্গীবাদের চেহারা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। এদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে মানবসভ্যতা থাকবে না। দলীয় প্রধানের এই ভাষ্য দলের নেতা-কর্মী পর্যায়ে তেমন আবেদন রেখেছে, বলা যাবে না। যদি হতো তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে আটক জঙ্গী, সন্ত্রাসীদের মুক্ত করতে দলের নেতারা তদ্বির চালাত না। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তদন্তে যথেষ্ট গাফিলতি দেখা যায়। আটককৃতদের বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিংও নেই। ফলে তারা আটকের পর ছাড়া পেল কি না তার খোঁজ রাখা হয় না। যে কারণে ‘ফারাবী’ নামক জঙ্গীটি জামিনে ছাড়া পেয়ে হত্যার হুমকি দেয় অভিজিৎকে এবং তা ঘটেও। দেশে ৫টি জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ হলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। আরও ৩৭টি ছোট জঙ্গী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এই জঙ্গীদের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক মদদ এবং তা মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ শক্তির নিয়ন্ত্রণে। কতিপয় প্রচার মাধ্যম. গণমাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে জঙ্গীরা। বাংলাভাই যুগেও তা দেখা গেছে। জঙ্গীদের থাবা সর্বত্র ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। সরকারের একটি জঙ্গীবিরোধী সেল রয়েছে। তারা জনগণকে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গীদের তৎপরতা সম্পর্কে যেমন কোন তথ্য দেয় না, তেমনি জঙ্গীবিরোধী তৎপরতায় জনমত গড়ার কাজটিও করে না। তাই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে, যা আজও প্রকটিতÑ “হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে/হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে; কীটের গহ্বরে/অগাধ সাগর-জলে, নির্মল আকাশে,/হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা অনিচ্ছার বশে-/ চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে/ ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে।”
×