ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২ মার্চ ২০১৫

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

(১ মার্চের পর) দাড়িওয়ালা বয়স্ক এক মানুষকে দেখলাম রাস্তার একপাশে মরে পড়ে আছেন, হাতে পানের খিলি, মাথায় সাদা টুপি। কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। বুলেটে ঝাঁজরা। গাড়ির ভেতরেও কয়েকজন মরে পড়ে আছে। সবাই বয়সে তরুণ। পরে জেনেছি ওরা ছিল ছাত্রলীগের সদস্য। পাকি হানাদারদের প্রতিরোধ করার কাজে সবাইকে সংগঠিত করছিল। আমাদের মতো আরও অনেকে বেরিয়ে এসেছে রাস্তার আশপাশে। ভয়ে ভয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে চারদিকে। অনেকটা ফিসফিস করে কথা বলছে সবাই। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলাম ঘরে। এভাবে চলে গেল কয়েকদিন। আমাদের গলির সামনে, বড় রাস্তার ওপরে ডিসি হিল। ওখানে পাকি হানাদার বাহিনী আস্তানা গেড়েছিল। পাহারারত সেপাই আমাদের সবার গতিবিধির ওপর সব সময় নজর রাখত। বাবা সব জানালা থেকে পর্দা নামিয়ে ফেলেছিলেন, যাতে পাকিদের মনে কোনরকম সন্দেহ না জাগে। একদিন বিকেল বেলা, তারিখটা খুব সম্ভবত ১ এপ্রিল, সময়টা ৩টা/৪টার মতো হবে। বাবা দোতলায় বাড়িওয়ালার ঘরে বসে বাড়িওয়ালাসহ আরও দু-তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঘরে আমরা পাঁচ ভাইবোন আর মা। বাসায় ঢুকতেই প্রথমে পড়ে বসার ঘর। এই ঘরের ভেতর দিয়েই অন্যান্য ঘরে যেতে হয়। আমরা বসার ঘরেই ছিলাম। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে দরজার সামনে উদয় হলো একজন পাকিস্তানী সৈন্য। হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে ধরা আমাদের দিকে। লোকটা মধ্যবয়সী। ফর্সামতো দেখতে। দরজার পাশের বড় জানালার সামনে দেখি কমবয়সী একজন। সেও তাক করে আছে একটা অস্ত্র ঘরের দিকে। তৃতীয়জন জানালার অন্য পাশের দ্বিতীয় দরজার দিকে বন্দুক ধরে আছে। যদিও ঐ দরজাটা সব সময় বন্ধই থাকত। তখনও বন্ধই ছিল। প্রচণ্ড ভয়ে আমরা সবাই নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাথাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোন কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না তখন। দরজার সামনের পাকিটা মার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ইধার আও’। মা পা বাড়ানোর আগেই আমি হাত বাড়িয়ে বাধা দিলাম তাঁকে এগোতে। কেন সেদিন সেটা করেছিলাম, কোথা থেকেইবা ওই সাহসটুকু এসেছিল, আজও সেটা বুঝে উঠতে পারি না। মাকে থামিয়ে আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম পাকির দিকে। তার সামনে যেতেই বন্দুকের নলটা আমার বুকে ঠেকাল সে। উর্দুতে যা জিজ্ঞেস করল তার সারমর্ম হলো এই যে, ঘরে কোন আওয়ামী লীগের লোক আছে কিনা। আমাদের ঘরের কেউ আওয়ামী লীগ করে কিনা। তখন কিভাবে যে আমি তার কথা বুঝলাম এখনও সেটা ভাবলে অবাক লাগে। আসলে কিছু কিছু শব্দ যেমন আওয়ামী লীগ, লিডার, আর তার সঙ্গে তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি আমাকে তার কথা বুঝতে সাহায্য করেছিল। আমি কিন্তু তখন উর্দু বলতে বা বুঝতে পারতাম না। বাংলাতেই বলছিলাম যে, আমাদের ঘরে কোন আওয়ামী লীগের লোক বা লিডার নেই। সেও আমার শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে বুঝে নিচ্ছিল আমার কথা। আমি একপাশে সরে গিয়ে তাকে ঘরে ঢুকে দেখতে বললাম। বন্দুকের নলটা কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও সরেনি আমার বুক থেকে। আমি একপাশে সরার সঙ্গে সঙ্গে নলটাও সরেছে একইসঙ্গে। হঠাৎ করে তার চোখ গেল দরজার সরাসরি উল্টা দিকের দেয়ালে, যেখানে সেদিনই সকালে যিশুর মূর্তিসহ একটা ক্রস লাগিয়েছিল বাবা। সেটা দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোম ঈসাইয়া হো?’ ঈসা মানে যিশু এটা জানা ছিল। মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’। গলায় ঝোলানো আমার ক্রসটাও বের করে দেখালাম তাকে। এবার বন্দুকটা নামিয়ে নিল সে। বলল, ‘ম্যায়ভি ঈসাইয়াহুঁ।’ বাকি দু’জন সৈন্যকেও বন্দুক নামাতে বলল। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ডরাও মাত।’ আমি তখন মনে মনে শুধু প্রার্থনা করছিলাম, ‘সৃষ্টিকর্তা, এই হারামজাদাগুলো যেন দোতলায় না ওঠে।’ কারণ, দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা ঠিক আমাদের দরজার পাশ দিয়েই উঠে গেছে। বুকটা প্রচণ্ড জোরে ঢিপঢিপ করছিল। দোতলায় উঠে এতগুলো পুরুষ মানুষকে একসঙ্গে বসে কথা বলতে দেখলে আর রক্ষা ছিল না। একটা ম্যাসাকার হয়ে যেত। যা হোক, সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা শুনলেন। তিন পাকি হারামজাদাই এরপর সোজা বেরিয়ে গেল আমাদের পাড়া থেকে। (চলবে)
×