ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ প্রমাণে সহজ করতে আইনটি বাংলায় করা হচ্ছে ॥ খায়রুল হক

সাক্ষ্য আইন ১৪৩ বছর পর যুগোপযোগী করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১ মার্চ ২০১৫

সাক্ষ্য আইন ১৪৩ বছর পর যুগোপযোগী করা হচ্ছে

বিকাশ দত্ত ॥ দীর্ঘ ১৪৩ বছর পর সাক্ষ্য আইনকে যুগোপযোগী ও অপরাধ প্রমাণে সহজ করার কাজে হাত দিয়েছে আইন কমিশন। তাছাড়া সবাই যাতে বুঝতে পারে সে জন্য আইনটি সম্পূর্ণ বাংলায় করা হচ্ছে। ব্রিটিশদের সুবিধার্থে আইনটি করা হলেও দেড় শ’ বছর পর যুগোপযোগী করার প্রযোজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সাক্ষ্য উপস্থাপন কিংবা কোনকিছু প্রমাণের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের জটিলতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কমিশন বেশকিছু সংযোজন-বিয়োজন করছে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আইনে ইলেক্ট্রিক ডিভাইস ই-মেল, অডিও-ভিডিও সংযোজন করলে প্রমাণে সহজ হবে। এতে বিচারপ্রার্থীরা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি অপরাধ প্রমাণেও সহায়ক হবে। এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে দেশের সিনিয়র আইন বিশেষজ্ঞ, বিচারকসহ দেশের বিভিন্ন বারের সভাপতি ও সম্পাদকদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে। ১৮৭২ সালের এ আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য বেশকিছু সংযোজন ও বিয়োজন করা হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এটি সম্পূর্ণ বাংলায় করা হচ্ছে। এর কাজ প্রায় অর্ধেক হয়েছে। চলতি বছরের শেষের দিকে আইনটি সংশোধন করে আইন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হবে। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের সাবেক বিচারপতি, আইনজীবীসহ অনেকেই এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, আইনটি বাংলায় করছি। পাশাপাশি সাক্ষ্য প্রমাণের সহজতর করতে বেশকিছু সংযোজন-বিয়োজন করা হবে। কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আইন প্রণয়নসহ সমাজের যে সমস্ত বাধা-বিপত্তি আছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ‘মুসাফিরের কলামে’ লিখেছিলেনÑ পূর্বপাকিস্তান রুখে দাঁড়াও। এখন রুখে দাঁড়ানোর লোক নেই। সরকার-পুলিশের একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়। আমার মতে, এখন বাংলাদেশকে রুখে দাঁড়াতে হবে। উল্লেখ্য, ওই সময় অবজারভারের আব্দুস সালাম, সংবাদের জহুর হোসেন চৌধুরী, মানিক মিয়ারা সিদ্ধান্ত নেনÑ সমস্ত কাগজে হেডিং হবে পূর্বপাকিস্তান রুখে দাঁড়াও। তাদের সিদ্ধান্তে মানিক মিয়া ওই কলাম লেখেন। ব্রিটিশ আমলের এ আইনটি এখনও কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়নি। ফলে যেমন বিচারকরাও অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন, তেমনি বিচারপ্রার্থীরাও বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রথমত সাক্ষ্য আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী হালনাগাদ করার জন্য, দ্বিতীয়ত ভাষাগত জটিলতা কমিয়ে আনা। আইনটি এমনভাবে করা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। আইন কমিশনের দায়িত্বই হলো যে সমস্ত আইন জনগণের কাছে বোধগম্য নয় তা সহজ করে করা। এছাড়া রাষ্ট্রের ম্যান্ডেট হচ্ছে আইনগুলো বাংলায় করা। সে অনুযায়ী সাক্ষ্য আইনকে বাংলায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রমাণে ইলেকক্ট্রিক ডিভাইস, ই-মেল, অডিও-ভিডিও আনার ক্ষেত্রে জটিলতা ছিল। এবার এগুলোকে সংযোজন করা হচ্ছে। ৩০ বছর আগে মোবাইল ফোন, ই-মেলের ওপর নির্ভরযোগ্যতা ছিল না। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে এগুলো আসায় অপরাধের হারও বেড়ে গেছে। কিন্তু আইনে এগুলো দাখিল করার বিধান না থাকায় জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো অনুধাবন করেই আইন কমিশন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো আদালতে উপস্থাপনের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের চেষ্টায় এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে রয়েছেন দুই সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও অধ্যাপক শাহ আলম। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি বতর্মান শ্রম এ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সামছুল হুদা মানিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাক্ষ্য আইন বহু পুরনো। এর রিভিউ প্রয়োজন। আদালতে ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীসহ অডিও-ভিডিও গ্রহণ করলে বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবে। অপরাধ প্রমাণে সহায়ক হবে। ইদানীং স্কাইপের মাধ্যমে ও মোবাইলে যে ধরনের অপরাধমূলক ফোনালাপ হচ্ছে সেগুলো যাতে দাললিক প্রমাণ হিসেবে আনা যায় তার জন্যই এ আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এতে বেশকিছু চ্যাপ্টার যোগ করা হচ্ছে। ওরালের পাশাপাশি ডকুমেন্টারি এ্যাভিডেন্স থাকবে। এ আইনে যে সমস্ত সাব-হেডিংস রয়েছে তা অত্যন্ত জটিল। সেগুলো যাতে সহজ করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। নতুন আইনটি হলে বিচারক, আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন। সাক্ষ্য আইন সত্য প্রকাশে সুরক্ষা দেয় না কিংবা উৎসাহিত করে না। বর্তমানে আদালতে এ শপথবাক্য পাঠ করার পরও সাক্ষীরা অবলীলায় অসত্য বলে যায়। প্রথম থেকেই সত্য গোপন করতে পারে এ রকম ধারণা থেকেই শপথবাক্য পাঠ করানোর প্রয়োজন পড়ে। বর্তমানে মানুষের নৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক স্বার্থ তথা আরামপ্রিয়তার প্রতি ঝোঁক প্রবল। সৎ ও বিশ্বস্ত সাক্ষ্য দুষ্প্রাপ্য। কেননা আদর্শ জীবন কাউকে অনুপ্রাণিত করে না। সাক্ষ্য আইনে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে এর টেকনিক্যাল দিকগুলো সহজ করতে হবে। রাজনীতিতে সহিংসতা প্রাধান্য বিস্তার করছে। আগে যখন আইনটি হয়, তখন রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য, দেশপ্রেমের তাগিদে। এখন পেট্রোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতায় মসনদে যাওয়ার জঘন্য প্রবৃত্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আদালতে কোন অপরাধ বা বিরোধ, কোন অপরাধের বিচার বা কোন বিচারের নিষ্পত্তির জন্য সাক্ষ্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। সাবেক জেলা জজ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হৃষীকেশ সাহা জনকণ্ঠকে বলেছেন, ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭২ সালে সাক্ষ্য আইনটি প্রবর্তিত করেছিল। ’৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তান আমলেও আইনটি প্রচলিত থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ নামে আইনটি চালু আছে। বলতে গেলে সুদীর্ঘ ১৪৩ বছর ধরে আদালত এ অপরাধের বিচার কিংবা বিশেষ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ প্রয়োগ করা হচ্ছে। বর্তমানে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে আইনটির প্রায়োগিকতা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি বর্তমান রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে আগামী ১০০ বছরের পর্যন্ত যাতে আইনটি জনকল্যাণমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে সে জন্য বিশেষ গবেষণা প্রয়োজন। সাক্ষ্য উপস্থাপন কিংবা কোনকিছুর প্রমাণের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের প্রক্রিয়াগত জটিলতা হ্রাস করতে হবে।
×