ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্তরে স্তরে পুলিশের পাহারা, কিভাবে পালাল ঘাতক

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

স্তরে স্তরে পুলিশের পাহারা, কিভাবে পালাল ঘাতক

ফিরোজ মান্না ॥ রাত তখন নয়টা বেজে কয়েক মিনিট। অভিজিত ও রাফিদা আহমেদ বন্যা দম্পতি মেলা থেকে ফিরছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, সাধারণ মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে লোকারণ্য। এরই মধ্যে অভিজিত ও রাফিদা দম্পতির ওপরে চাপাতি নিয়ে হামলা করা হয়। প্রকাশ্যে এত মানুষ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সদস্যদের উপস্থিতিতে এমন নৃশংস হত্যাকা-ের পর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই নয়, সমগ্র দেশের জনসাধারণের মনে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। অভিজিত ও রাফিদাকে যখন হামলা করা হয়, এর মাত্র ১৬ গজ দূরেই রাজু ভাস্কর্যের সামনে বইমেলার প্রবেশের প্রধান ফটকে প্রায় ২০ জন পুলিশ বসেছিলেন। এর থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে ১০-১২ জন পুলিশ ছিলেন। শাহবাগ মোড়ের বুথে ছিলেন ১০ থেকে ১৫ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসার সামনে প্রায় ১০ জন পুলিশ সব সময়ই থাকেন। শহীদ মিনারে যেতে শামসুন নাহার হলের সামনে অল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা, দোয়েল চত্বর এলাকা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনেও পুলিশ সদস্য ছিলেন। নীলক্ষেত ও পলাশীর মোড়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের মোট আটটি প্রবেশপথের প্রতিটিতেই পুলিশের উপস্থিতি ছিল। বইমেলা উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়। এতকিছুর পরেও ঘাতকরা খুব সহজেই হত্যাকা- ঘটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ অভিজিতকে হত্যার দায় যে সংগঠনই স্বীকার করুক না কেন, প্রগতিশীলদের নিরাপত্তা দানে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাই সামনে চলে আসছে। অভিজিতকে হত্যার দুই ঘণ্টা আগেও টুইটারে তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ১৮ দিন আগে ৯ ফেব্রুয়ারি শহীদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় জামিনে বেরিয়ে আসা উগ্রপন্থী ব্লগার ফারাবী শফিউর রহমান হুমকি দিয়েছিল, ‘অভিজিত এখন যুক্তরাষ্ট্রে। তাই তাকে এখন হত্যা করা যাবে না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখনই তাকে হত্যা করা হবে।’ সরকার যোগাযোগের সব মাধ্যমে নজর রাখলেও অভিজিতকে হত্যা বিষয়টিতে কেন নজর রাখল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একের পর এক প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগারকে ঘোষণা দিয়ে হত্যার উৎসব পালন করছে উগবাদীরা। শাহাবাগে অভিজিত হত্যার প্রতিবাদকারীদের মুখে এমন কথাই উচ্চারিত হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, অভিজিতকে হত্যার হুমকি দেয়ার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবকিছু জানে। ইচ্ছা করলে সরকার হত্যাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনতে পারে। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকা প্রগতিশীল এ লেখকের হত্যার পর থেকেই রীতিমতো উল্লাস চলছে জামায়াত-শিবিরের ‘বাঁশের কেল্লা’য়। একই সঙ্গে অভিজিতের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে শিবির নেতাকর্মীরা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে অভিজিতকে ইসলামবিরোধী শক্তির লোক বলে অপপ্রচার চালানোর কয়েক হাজার জামায়াত-শিবিরকর্মী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ক্রমাগত অপপ্রচার কাজে লেগে গেছে। হত্যাকারীর মূল হোতা ফারাবী শফিউর রহমান গত কিছুদিন ধরে ফেসবুকে অভিজিতকে হত্যার জন্য নানা ধরনের স্ট্যাটাস দিয়ে গেলেও তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এই ফারাবীকে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে সে জামিনে বের হয়ে প্রগতিশীলদের হত্যার জন্য ফেসবুক, বাঁশের কেল্লা, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে কথা বলে যাচ্ছে। এতেও সরকার বিষয়টির দিকে কোন নজর দেয়নি। উল্টো প্রগতিশীল ব্লগার ও লেখকদের বিরুদ্ধে সরকার বার বার নানাভাবে হয়রানি করেছে। এমন অভিযোগ প্রগতিশীল ব্লগারদের। এদিকে ফারাবী প্রকাশ্যে গত কয়েক মাস ধরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। তার একটি স্ট্যাটাসÑ ‘বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনীর প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, আমাদের সাধারণ জনগণের হাতে তো অস্ত্র নাই। কিন্তু আপনাদের হাতে তো অস্ত্র আছে। তো আপনারা কি পারেন না যারা প্রতিমুহূর্তে নেট জগতে রাসূল্লাহকে অশ্লীল গালিগালাজ করে যাচ্ছে তাদের হত্যা করতে?’ ফারাবী এই পোস্টে আটটি ফেসবুক আইডি ও চারটি ব্লগের প্রশাসকের নাম দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার দাবি করেছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে পোস্টগুলো ধরা পড়েনি। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভাইবারের মতো সার্ভিসকেও নজরে রাখতে পারে। কিন্তু ফেসবুক ব্লগের দিকে তাদের কোন নজর নেই। এমন প্রশ্ন এখন সারাদেশের মানুষের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক ছাত্র ফারাবী গত বছরের ২১ অগাস্ট হাইকোর্ট থেকে জামিনে বের হয়ে আসার পর থেকেই একের পর এক উগ্র স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন ওই আন্দোলনের কর্মী ব্লগার রাজীব হায়দার। এরপর ফারাবী তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে।’ ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে পুলিশ ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে। ফেসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গত বছরের জুন মাসে ফারাবীর বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। অন্যদিকে বিডিনিউজ জানিয়েছে, হত্যার উস্কানি দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ‘ব্লগার’ ফারাবী শফিউর রহমান শনিবার লেখক অভিজিত রায়ের বই বিক্রি তালিকা থেকে সরিয়ে না নিলে রকমারির কার্যালয়ে আক্রমণ করা হবে বলে ফেসবুকে হুমকি দেয়। অভিজিত রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটিকে ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয় হুমকিতে। সৈয়দ আবুল মকসুদ, ফারুক ওয়াসীফের বইয়ের বিজ্ঞাপনও এই রকমারি ওয়েবসাইটের প্রথম পৃষ্ঠায় থাকে না, কিন্তু ঠিকই অভিজিত রায়/ভাইরাস জিত রায়ের বইগুলোর বিজ্ঞাপন রকমারি ওয়েবসাইটের প্রথম পৃষ্ঠায় থাকে। অভিজিত রায়ের বইগুলোতে নতুন কিছু নেই। অভিজিত রায়ের বইগুলো সব খ্রীস্টান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত ওয়েবসাইট থেকে কপিপেস্ট করা। আনসারিং ইসলাম এই ওয়েবসাইটটির লেখাগুলি চুরি করে তারপর বাংলা অনুবাদ করে অভিজিত রায় তাঁর নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। ফারাবীর হুমকির প্রত্যুত্তরে রকমারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও মাহমুদুল হাসান সোহাগ তাকে বইটিকে ‘নেগেটিভ রেটিং’ দেয়ার এবং ওয়েবসাইটে রিভিউ মন্তব্যের মাধ্যমে মতপ্রকাশের পরামর্শ দেন। এতে সন্তুষ্ট না হলে অভিজিত রায় প্রণীত বইগুলোকে ওয়েবসাইটে ‘আউট অব প্রিন্ট’ চিহ্নিত করে রাখা হয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অভিজিত রায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রকমারির উচিত লেখকের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল থাকা। আমার বই রাত্র থেকে ব্যান্ড করা হয়নি, আদালতে যায়নি। ফারাবীই বরং আদালতে চার্জশিটপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি।’ আমরা তো কোনো ধর্মীয় বই তালিকা থেকে সরাতে বলছি না। শুধু ধর্মীয় বই কেন, বহু জিহাদী বাণীসমৃদ্ধ উগ্র বইপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় রাজাকারদের লেখা বই রকমারিতে পাওয়া যায়। অভিজিত রায় ‘মুক্তমনা ডটকম’ নামের একটি কমিউনিটি ব্লগিং সাইটের উদ্যোক্তা। জানা গেছে, বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত বিতর্কিত ও ধর্মবিদ্বেষী লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পরিচালিত ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাইটটিতে ঢুকতে চাইলে লেখা আসেÑ কারিগরি ত্রুটির জন্য সাইটটি বন্ধ রয়েছে। ফারাবীর আরেকটি স্ট্যাটাসে বলা হয়, মুক্তমনা ব্লগ ছিল মূলত একটি ইসলামবিদ্বেষী ওয়েবসাইট। এই সাইটে সংঘবদ্বভাবে তথাকথিত মুক্তমনা ব্লগাররা ব্লগিং করত। বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করাই ছিল এই ব্লগের ব্লগারদের কাজ। তাই বিতর্কিত লেখক অভিজিত রায় ও ওই ব্লগের ব্লগারদের ইসলামবিদ্বেষী লেখা যেন সাধারণ মানুষের চোখে না পড়ে এ কারণেই মূলত ব্লগটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে এখনও ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট আর্কাইভ করে রাখার সাইট webarchive.com-এ ব্লগটির অনেকগুলো লেখা সক্রিয় রয়েছে। এমনকি ওয়েব আর্কাইভে গিয়ে অভিজিত রায়ের লেখা ব্লগের লিঙ্কও পাওয়া যাচ্ছে। অভিজিত রায়ের লেখা ব্লগের লিঙ্ক হলো : http: web.archive.org/.../http//mukto-mona.com/bangla-blog অভিজিত রায় ছিলেন একজন অসম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তমনা মানুষ। তাঁকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ’ কর্মী এই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। হাজারো অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য পোস্ট করছে অভিজিতের বিরুদ্ধে। অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ মানুষও। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদের মতো অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন, যাঁরা ছিলেন নাস্তিক এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনার সমালোচনাও করে এসেছেন বিভিন্ন সময়। তাঁদের পৃথিবীতে রাখা হয়নি। তাঁদের পথে যারা হাঁটবে তাঁদেরও দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না।
×