ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হরতাল অবরোধের দফারফা ॥ নাশকতা প্রত্যাখ্যান

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

হরতাল অবরোধের দফারফা ॥ নাশকতা প্রত্যাখ্যান

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা। ঘটনাস্থল রাজধানীর বিজয় সরণির মোড়। দীর্ঘ যানজটে আটকে আছেন সিএনজি চালক হোসেন আলী। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যাবেন-জিজ্ঞেস করতেই ক্ষুব্ধ হোসেন আলীর উত্তর, ‘মামা ক্যামনে যামু? জ্যামে এই এক জায়গাতেই আটকে আছি আধাঘণ্টা। আবার নাকি খালেদা জিয়া হরতাল অবরোধ দুটোই দিছে। কোথায় হরতাল, কোথায়? বোমা মারায় আগে হরতালে গাড়ি নামাইতে ভয় করত। এখন আর মনে হেই (সেই) ভয় নাই। দ্যাখেন না কেউ মানে না হরতাল? কেউ মানে না তাও খালেদার লজ্জা হয় না। ওনার লজ্জা একাত্তরেই ভেঙ্গে দিয়েছে পাকিস্তানীরা! হোসেন আলী একটু দম নিয়েই বললেন, ওঠেন মামা। এর ১০ মিনিট পর সিএনজি একটু একটু করে চলা শুরু করল। তবে হোসেন আলীর মতো প্রতিটি মানুষ প্রকাশ্যে ক্ষোভ না ঝাড়লেও রাজপথের ভয়াবহ যানজটই বলে দিচ্ছে হরতাল অবরোধের নামে নাশকতাকে প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। কেউ মানছে না, জনসম্পৃক্ততাও নেই, তবু টানা ৫৩ দিন ধরে অবরোধের মাঝেই দফায় দফায় হরতালের ঘোষণা দিয়ে একে পুরোপুরি অকার্যকর কর্মসূচীতে পরিণত করে ফেলেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। হরতাল অবরোধ ভেঙ্গে রাজপথে নেমে পড়েছে মানুষ। মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্মে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না হরতাল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা উপহার করে হলেও বিএনপিকে ধন্যবাদ দিয়ে বলছেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট কারণে অকারণে হরতাল-অবরোধ দিয়ে নাশকতা চালিয়ে দেশের জন্য ক্ষতিকর একটি কর্মসূচী সম্পর্কে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে। বিএনপি-জামায়াত ভুল করলেও দেশের জন্য উপকারই হয়েছেÑ এমন মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে নাশকতামূলক কর্মসূচী দেশের জন্য হতে পারে না। এভাবে কোন কর্মসূচী চলতে পারে না। তাই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হরতাল প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে হরতালসহ নাশকতামূলক কর্মসূচী। আগে ছোট একটি সামাজিক সংগঠন হরতাল দিলেও মানুষের যে সাড়া মিলত এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০ দল মিলে অবরোধ-হরতাল এক সঙ্গে দিলেও যানজটই দেখা যায় রাজপথে। এদিকে রাজধানী থেকে শুরু করে সারাদেশে যানচলাচল স্বাভাবিক, বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়াও কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। তবে দেশের মানুষ ও দেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত নেতারা রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করলেও হরতাল অবরোধে পুরোপুরি সচল আছে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য। অবরোধের জোর কমে যাওয়ায় ২০ দলীয় জোট এখন সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসেই হরতাল যোগ করেছে; কিন্তু তার মধ্যেও ঢাকায় নিত্য যানজটে পড়ছে মানুষ। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম। এসএসসি পরীক্ষার শুরু থেকে অবরোধের গায়ে গায়ে ডাকা হরতালও এখন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে মানুষের। পাল্টে ফেলা হয়েছে হরতালের আসল চেহারা ॥ আভিধানিক অর্থ দোকান পাট ও দরজা বন্ধ রাখা হলেও গুজরাটি ভাষার ‘হরতাল’ দেশের মানুষের কাছে এখন ক্ষয় ক্ষতি আর আতঙ্কের নাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর জামায়াতীদের বর্বরতা আর গত প্রায় দুই মাসে বিএনপি-জামায়াত জোটের নাশকতায় মানুষের কাছে পাল্টে গেছে হরতালের অর্থ। এক সময়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন হরতালের মানে নাশকতা, তা-ব, সহিংসতা, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ ধ্বংসযজ্ঞ। মানুষের সমর্থন নেই তবু কারণে অকারণে দিনের পর দিন হরতাল দেয়া হচ্ছে। তা মানতেও বাধ্য করা হচ্ছে মানুষ পুুড়িয়ে। এমনকি আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আদালতের বিরুদ্ধেই হরতাল দিচ্ছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াত-শিবির। হরতাল রীতিমতো রাজনৈতিক সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। যেখানে দেশ, দেশের মানুষের স্বার্থের কোন স্থান নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশে অন্যরকম এক শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করেছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। দেশবাসী সেই হরতালে সমর্থন দিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ সারাদেশেই হরতাল পালিত হয় কোন গোলযোগ ছাড়াই। ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের দফতরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হরতাল একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচী। এটি শান্তিপূর্ণ হলে মানুষের সাড়া মেলে। গণদাবি হওয়ায় সিপিবি-বাসদের হরতালও সফল হয়েছিল। কিন্তু এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের মাসের পর মাস নাশকতার হরতাল অবরোধকে ‘না’ বলে দিয়েছে পুরো দেশ। গত ৫৩ দিনে কথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের নামে জোপের ক্যাডাররা পুুড়িয়ে মেড়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষকে। তবু এখন আর ভয় নেই। বরং প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হরতাল অবরোধকারীদের ধরে গণধোলাই দিচ্ছে জনতা। ইতোমধ্যে হরতাল অবরোধকারী একাধিক বোমাবাজকে গণধোলাই দিয়ে মেরেও ফেলেছে সাধারণ মানুষ। হরতাল-অবরোধ এক সঙ্গে দিলেও মানুষ শঙ্কা কাটিয়ে নিজের রুটি-রুজির জন্য কর্মস্থলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় এই সপ্তাহের হরতাল অবরোধেও ছিল ভয়াবহ যানজট। এ সময়ে দূরপাল্লার বাসও ছেড়ে গেছে ঢাকা থেকে। বিভিন্ন শহর থেকেও রাজধানীতে এসেছে দূরপাল্লার বাস। ট্রেন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সড়ক-মহাসড়কে নাশকতা না থাকায় পণ্য পরিবহনও ছিল স্বাভাবিক। ফলে জিনিসপত্রের দামও হয়েছে নিম্নমুখী। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত হরতাল দিলেও নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। হরতাল অকার্যকর হয়ে গেছে। দৃশ্যতা ধীরে ধীরে হরতাল ভোঁতা হয়ে গেছে। টানা অবরোধ-হরতালের কোন প্রভাবই পড়ছে না সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রতিদিনের মতোই সকাল থেকেই কর্মসংস্থানে ছুটছে মানুষ। ফলে সাধারণ দিনের মতো শহরের মোড়ে মোড়ে অনেক সময় ধরেই দাঁড়িয়ে থাকছে যানবাহন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। শহরের বেশিরভাগ মানুষ কর্মজীবী। বাস চালসকসহ সাধারণ মানুষ এখন বলছে, আন্দোলন সহিংসতার নামে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারায় প্রথমদিকে সবাই হরতাল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু তা এখন আর কেউ মানছে না। অতঙ্ক ভুলে রাস্তায় নামছে। তাই তো এই হরতালেও যানজটের ভোগান্তিতেই পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ফার্মগেট মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ মোঃ ওসমান বলছিলেন, হরতাল কেউ মানছে না। সকাল থেকেই রাস্তায় যানচলাচল বেশি। এখন রাত পর্যন্ত গাড়ির চাপ। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সায়েন্স ল্যাবের মোড়ের সিগন্যালে দাঁড়ানো রয়েছে কয়েকটি গাড়ি। সে গাড়িতে ঝুলে আছেন যাত্রীরা। গাড়িতে এমন ঝুলে থাকা যাত্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে হরতালের কোন প্রভাব নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে। কথা হলো গাড়ির ড্রাইভার আকবরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পেট্রোলবোমার উৎপাত কমছে বলে লোকজন বাইর হইছে। মানষের ভয়-ডরও কমছে। এখন আমরা খাইয়া পইরা বাঁচতে পারুম। এইসব হরতাল ফরতাল কাগো জন্য? ওইয়া নেতা নেত্রীরা বুঝবো।’ তবে এখনও শঙ্কায় আছেন অনেকে। কারওয়ানবাজারে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কলেজ ছাত্র নিয়ন জানায়, আজকে গাড়ি চলাচল দেখে মনে হচ্ছে হরতাল নেই। তারপরও বলা তো যায় না, কখন কি হয়ে যায়। সচল বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ॥ হরতালে অবরোধে পুরোপুরি সচল এখন বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সব প্রতিষ্ঠানই। বিএনপি নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরতাল চলাকালে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দলের ব্যবসায়ী নেতাদের কর্পোরেট অফিস, বাণিজ্যিক অফিস ও শিল্প-কারখানা খোলা। কোন হরতালেই দলটির শীর্ষ নেতাদের কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়নি। উৎপাদনসহ অন্যান্য দাফতরিক কাজ হয়েছে পুরোদমে। প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হারুন অর রশীদ খান মুন্নু, বিএনপির কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, চেয়ারপার্সনের আরেক উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের সব নেতাদের প্রতিষ্ঠানই হরতালে খোলা থাকছে। হারুন অর রশীদ খান মুন্নুর মালিকানাধীন ঢাকার ধামরাইয়ে মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হরতালে খোলা। উৎপাদন বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত কোন হরতালে বন্ধ হয়নি মুন্নু সিরামিকস। হরতালের দিনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই এ প্রতিষ্ঠান চলে। গাজীপুরে জয়নুল আবদিন ফারুকের মালিকানাধীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বিজি কানেকশনও হরতালে খোলা রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক এমপি জিএম সিরাজসহ প্রথম ও মধ্য সারির আরও বহু নেতার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন চালু রয়েছে। কল্যাণপুরে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা এসএ খালেকের সিএনজি স্টেশন ‘খালেক সার্ভিস স্টেশন সচল। হরতাল-অবরোধে এ স্টেশন বন্ধ রাখার জন্য মালিকপক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কি-না প্রশ্ন করা হলে এক কর্মকর্তা বলেন, এ বিসয়ে মালিকের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি। বিএনপির বগুড়ার সাবেক এমপি জিএম সিরাজের এসআর ট্রাভেলস, বিএনপির সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ কফিল উদ্দিনের হানিফ পরিবহন হরতাল-অবরোধের গত এক মাসে একদিনও বন্ধ থাকেনি। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা ৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাকারিয়া তাহেরের রাজধানীর মহাখালী লিংক রোডে আমার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর সঙ্গে লিংক রোডে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিরও অংশীদার তিনি। বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হরতাল-অবরোধের মধ্যেও খোলা থাকে। এছাড়া হরতাল-অবরোধে রাজধানীতেই বিএনপি জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের বাস চলাচল করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ঢাকা পরিবহনের মালিক। কিন্তু হরতাল-অবরোধেও ঢাকা পরিবহনের বাস রাজধানীতে চলাচল করছে। আর উইনারের পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম কাজল। এই বাসটিও আজিমপুর, পান্থপথ, বাড্ডা, রামপুরা রোডে চলাচল করছে। অনাবিল, ছালছাবিল, বৈশাখী ও লাব্বাইক পরিবহনের মালিকরাও বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতা। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ঢাকা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন। এই ব্যাংকটিও অন্যান্য ব্যাংকের মতো হরতালের দিনে খোলা থাকছে। দল ছাড়ছেন নেতাকর্মীরা ॥ গত ঠিক এক মাস আগের ঘটনা। বিএনপির ডাকা হরতাল অবরোধে পেট্রোলবোমা হামলায় এক মাস আগে নিহত হয়েছেন বিএনপির এক নেতার পিতা। নিজ পিতাকে হারিয়ে হতাশ বীতশ্রদ্ধ নীলফামারী সদরের লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের সভাপতি আবদুল মতিন। পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন তার পিতা আবদুল মালেক। বাবাকে হারানোর পর আবদুল মতিন বলেন, আমি আর বিএনপির রাজনীতি করব না, যে দল করি সেই দলের ডাকা অবরোধ আমার বাবার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন সহিংসতার রাজনীতি আমি চাই না। যারা এমন সহিংসতা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এদিকে সহিংসতার পথ বেছে নেয়ার কারণে চরম অস্থিরতা চলছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা বিএনপির রাজনীতিতে। প্রতিবাদস্বরূপ সহিংসতাকে ‘না’ জানিয়ে গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন মুক্তাগাছা উপজেলা ও পৌর বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতা। পদত্যাগের পাইপ লাইনে রয়েছেন আরও প্রায় ডজনখানেক নেতা। স্থানীয় উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও বাঁশাটী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোঃ হাবিবুর রহমান খান রতন দলীয় সব ধরনের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সাবেক পৌর মেয়র আলহাজ মানছুর রহমান রেজুন পৌর বিএনপির সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে হাবিবুর রহমান রতন বলেছেন, বর্তমানে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী আমার বিবেচনায় দেশ, দেশের জনগণ, গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার সম্পূর্ণ প্রতিকূল। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি কোনভাবেই এ রাজনীতি মেনে নিতে পারি না। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎপর শিবির ॥ হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বন্ধ হচ্ছে রাজধানীর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গত রবিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত নর্থসউথ ইউনিভার্সিটির কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস বন্ধের দাবি তুললে সোমবার ওই দাবি প্রতিষ্ঠানটির গ-ী পেরিয়ে আশপাশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হঠাৎ করেই এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধে ছাত্রদের কথিত আন্দোলনের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের প্রত্যক্ষ ইন্ধন রয়েছে দাবি করেছেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও বিষয়টি নজরে এসেছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিবিরের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সক্রিয় তৎপরতার কারণেই শিক্ষার্থীরা অনেকটা বাধ্য হয়ে বিক্ষোভ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। জানা গেছে, ক্যাম্পাস সচল থাকায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টার্গেট করেছে শিবির। পাশাপাশি জামায়াত-প্রভাবিত কিছু প্রতিষ্ঠান বিএনপি জোটের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ রয়েছেÑ এমনটি প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ কারণেই মঙ্গলবার নর্থসাউথ, ইস্ট-ওয়েস্ট, ব্র্যাক, ইনডিপেন্ডেন্ট, সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটি ও আমেরিকান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ক্লাস গ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করা হচ্ছে জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত ইসলামী ইউনিভার্সিটি, নর্দান, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চিটাগাংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে তুলতে উস্কানিদাতা শিবিরের নেতাদের পরিচয়ও মিলেছে অনেকের। উস্কানিদাতারা শিবিরের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। জড়িত রয়েছেন সভাপতি অলিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাসেত, সহ-সভাপতি তারেক আব্দুল্লাহ এবং রিয়াজুল হক রিয়াজ। দফতর সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, সমাজ কল্যাণ সম্পাদক রাজিবুল ইসলাম, গবেষণা সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক পারভেজ আলী। এছাড়াও হিযবুত তাহরিরের মতো সংগঠনে জড়িত ছাত্ররাও এ আন্দোলনে শিবিরের সঙ্গে কাজ করছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মঙ্গলবার যে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিক্ষোভ হয়েছে, ওই সময়েই ছাত্রশিবিরের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা একযোগে সক্রিয় ছিল। ওই সময় তারা বিক্ষোভের ছবিসহ খবর গণমাধ্যমে পাঠায়। মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে ফিরোজ মাহমুদের মেইল থেকে গণমাধ্যমে ‘হরতালে ক্লাস বন্ধের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ’ শীর্ষক একটি বিবৃতি পাঠানো হয়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ২০ দলীয় জোটের টানা হরতাল-অবরোধের মাঝে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে ক্লাস চালু রাখার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে রাজধানীর বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আরও বলা হয়, মঙ্গলবার বনানীর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ করে। তবে তারপরও সুবিধা করতে পরছে না বিএনপি-জামায়াত জোট। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালগুলো আজ শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবারও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখছে। রবিবার থেকেও চলবে কার্যক্রম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচী যারা দিচ্ছেন তাদের ধন্যবাদ দিতে হবে এ কারণে যে, কারণে অকারণে হরতাল-অবরোধ দিয়ে নাশকতা চালিয়ে দেশের জন্য ক্ষতিকর একটি কর্মসূচী সম্পর্কে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে তারা। বিএনপি-জামায়াত ভুল করলেও দেশের জন্য উপকারই হয়েছেÑ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে নাশকতামূলক কর্মসূচী দেশের জন্য হতে পারে না। এভাবে কোন কর্মসূচী চলতে পারে না। তাই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হরতাল প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। ভবিষ্যতে এই কর্মসূচী কেউ দিলেও কাজ হবে না। এটা মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলছিলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশ এটা। সকলে বুঝে গেছে ওরা আসলে কি চায়। এরা কোনদিন আর সাড়া পাবে না। তবে এ ইতিহাসবিদ বলছিলেন, এখন যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের। এ যুদ্ধ বন্ধ হবে না। হরতাল অবরোধ বন্ধ করলেও তারা জঙ্গীবাদী তৎপরতা বোমা হামলা চালাবেই। তারা পাকিস্তানকেই চায়। এদিকে হরতাল অকার্যকর হওয়া নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় বইছে। রাজিব তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, বিএনপি-জামায়াত হরতাল অবরোধের ইমেজ নষ্ট করেছে আজীবনের জন্য! বলেছেন, এইগুলা হরতাল না। শুধু খালেদা হাজিরা দিতে না যাওয়ার ফন্দি। মানুষ বুঝে গেছে। গলায় দড়ি দেয়া উচিত ‘খালেদার’ এখন।
×