ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

মাই নেম ডেভিড এডওয়ার্ড

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মাই নেম ডেভিড এডওয়ার্ড

কাজ করেন। পাঁচক। আয়ের একাংশ পাঠাতেন বছর দশেক আগেও। বন্ধ করেছেন পাঠানো। হেতু, এডওয়ার্ডের কথা, আমার আব্বাজান হারামি। আমার পাঠানো টাকায় আব্বাজান এ্যাকটা নিকা কইরা মারে তালাক দিছে। এডওয়ার্ড সাবলাইম রসিক। বলেন, দাদাবাবু, আমার স্ত্রী আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়। ওর দুই মাইয়া আছে। দামাদরে তালাক দিছিলো। আমার লগে রেস্তরাঁয় মোলাকাত। মোলাকাতের সময় সে আমারে কয় নাই দুইডা মাইয়া আছে। জানেন তো, জান বাঁচানো ফরজ। এই দ্যাশে খাকানোর জন্যে সাদী করলাম। সে কইলো আমার দুই মাইয়া কই যাইবো। আপনারে আমার স্ত্রীরে দেখাইমু না। ওই আমার স্ত্রী বাঘে মারলে সাতদিন খাইবো। তারপর বাঘ আর সাতদিন খাইবো না। তারপর বাঘের পেট খারাপ হইবো। গাগতরে ১৮২ কিলো। খায় আর ঘুমায়। বাজার, রান্না আমারেই করতে হয়। দ্যাশে কই নাই বিয়া করছি। তার আরো কথা, জাতে খ্রীস্টান, আমারে জিগায়, খাওয়ার আগে বিসমিল্লা কও কী কামে। আমি কই, ওডা আমাগো দ্যাশের কালচার। আরো জিগায়, সকালে উইঠা কী করো, ঘুমানোর আগে কী করো। কই যোগব্যায়াম। কই না নামাজ পড়ি। তিনি তো ওই শরিলে যোগব্যায়াম করবার পারে না, আল্লাহ মাবুদ। নানা প্রোগ্রাম সত্ত্বেও দুইদিন এডওয়ার্ডের সঙ্গে কাটাই। পাবনার ডায়লগ শোনাই পরম পাওনা। বন্ধুদের ডাকেন তিনি, ‘দাদা কলিকাতার, পাবনায় গিয়াছিলেন, পাবনার দোহারপাড়ার হাকিমউদ্দীন জমিদারের বাড়িও চেনেন। হাকিমউদ্দীন চাচার ছাওয়ালপলদেরও চেনেন। চাচার এক ছাওয়াল রোকন, রোকনভাই, তারেও এই দাদা চেনেন। আপনারে রেস্তরাঁয় লইয়া যামু। কারফেন (কার্ভ) মাছ খাওয়ামু। নিজের পরিচয় ব্যতিরেকে কলকাতার দাদা হওয়াই উত্তম। আর্মেনিয়ার ইতিহাস আপনারা জানেন। বিশদ বলা কচকচানি। সংক্ষিপ্ত বললেও সংক্ষিপ্ত হবে না। দুই হাজার বছরের নানা টানাপোড়েন, যুদ্ধ, সংগ্রামের এই দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান আবদুল হামিদ (১৮৯৪-৯৬) এবং ইয়াং তুর্ক সরকারের (১৯১৫-১৭) দক্ষযজ্ঞ-হত্যায় কিভাবে ছারখার হয়েছিল, ২৫ লাখ খ্রীস্টান হত্যা করা হয়, রাশিয়া কিভাবে উদ্ধার করে, সবই জানেন। ম্যাসাকার তথা হত্যাযজ্ঞের শতবর্ষ উপলক্ষে হরেক অনুষ্ঠান, সবই বিষাদমাখা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর হত্যালীলা বাংলাদেশে, কতটা ভয়ঙ্কর, একই নকশার চিত্রমালায় হেরফের কিনা, শুনতে চান শ্রোতা। বলি। বয়স্কদের কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেন। চোখের জল মুছি। উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার চেহারাচরিত্র, ভূগোল, সমাজ-মানুষ সবই চেনা, ঘুরতে হয়, নানা উপলক্ষে, বক্তৃতায়, সাহিত্য সেমিনারে। পূর্ব ইউরোপ তো ওপাড়া। মন মন বেড়ানোয় ঘুরেপেরা। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়ারভান (ওরা বলে ইয়ারেভানে) এতটা আত্মিক হবে, ভাবিনি। অসাধারণ সুন্দর শহর। ছিমছাম। কেয়ারি বাগান। ইভান লেক। মেয়েগুলো পাহাড় থেকে যেন ডানাকাটা পরি। স্তন ডৌল। লাবণ্যে স্বর্গীয়। কামমাখা। খাদ নেই শরীরে। ভুলেও যদি বলেন, ‘হামবুড়ি’ বিপদ। হামবুড়ি মানে চুম্বন। কোন তরুণী চুম্বন দেবে গালে। ‘সোসে’ বললে আরো বিপদ। সোসে মানে সুন্দরী বক্ষ। সোসে বললে সুন্দরী বক্ষ জড়িয়ে ধরলে দোষ নেই, নাচ করবেন তার সঙ্গে। তার আগে যদি জানান, আপনি ঢাকা বা কলকাতার, বলেন, আমার দেশ তোমার কালচারে এখনো জ্বলন্ত, বিশ্বাস করবে না। বলতে হবে, বিশ্বাস করছো না? চলো ঢাকায়। পুরোনো ঢাকার একটি অঞ্চলের নামই আর্মানিটোলা। আর্মেনিয়াদের নামেই। ঢাকায় আর্মেনিয়ান চার্চও আছে। ইংরেজের যাওয়ার আগেই আর্মেনিয়ান চার্চ তৈরি। কলকাতায় যাও, দেখবে আর্মেনি গির্জা। কবর। এমনকি আর্মেনি সাহেবের স্ত্রী সুকিয়ার নামে স্ট্রিট, সুকিয়া স্ট্রিট। এই স্ট্রিট এখনও বহাল। ইংরেজের আগে কলকাতায় তোমরাই ছিলে পিতামহ। বিপন্ন ইংরেজকে তোমরাই রক্ষা করেছ এবং ইংরেজরাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। মিসেস সেডারকিন।।ধ্বংসের খেসারত দিচ্ছ। শুনছি, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হলেও, ইংরেজীই পয়লা। সর্বস্তরের ভাষা। ভারতীয়দের লজ্জা করে না? প্রশ্ন এতই মারাত্মক, এড়িয়ে বলি, মাল্টি লাঙ্গুয়াল দেশ। মিসেস সেডারকিন।। নিজের মাতৃভাষা ভুলে ? বলি, গ্লোবালাইজেশনে ভুলে যাচ্ছি মাতৃভাষা। ভুলিয়ে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। না ভুললে গ্লোবাল নই। হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছি। ...পেলেও, কী করে ভুলি কৈশোরের ঢাকার আর্মেনিটোলা, যৌবনের কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট ? তিন শ’ বা পাঁচ শ’ পৃষ্ঠার ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন? নানা দুর্নাম, অপবাদ। জার্মানদের নির্মম রসিকতা, লেখক নিশ্চয় ওই শহরে বা দেশে তিনদিন বা পাঁচদিন ছিলেন। তিন মাস কিংবা পাঁচ মাস থাকলে ৩০০ লাইন বা ৫০০ লাইন লিখতেন না, তিন বছর বা পাঁচ বছর একনাগাড়ে বাস করলে তিন, পাঁচ লাইনও নয়। কেননা, দেশসমাজের ভিতরমহলে ঢুকছেন, প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় শামিল হচ্ছেন, সমস্যার সঙ্গে নিজেও জড়িয়ে পড়ছেন, পারিপার্শ্বিক হয়ে উঠছে ঘরোয়া, নিজেও তখন জলহাওয়ায় সামাজিক। সুখ-দুঃখের ভাগী। রঙিন চোখে কিছু দেখছেন না। উড়োগল্প শুনছেন না। যাচাই করে নিচ্ছেন সবকিছু। চোখ-কান খোলা থাকছে। বাংলা ভাষায় কয়েকজন লেখককে জানি, দরকার নেই নাম বলা, কোন শহরে দুইদিন ঘুরে ঢাউস ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। হিম্মত বটে!! প্রেমেন্দ্র মিত্রকে দোষ দেয়া যাবে না, বার্লিনে আসেননি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা বার্লিনে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে ঘুরছেন, লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র : ‘কাইজার উইলহেল্মস্ট্রাস... চমকে উঠবেন না, ওটা রাস্তার নাম...তা থেকে বেঁকে একটা সরু গলি রাস্তায় চলেছি... । ইত্যাদি। গল্পের খাতিরে মেনে নিচ্ছি এই বর্ণনা। ফুটনোট এই : রাস্তার নাম কাইজার উইলহেল্মস্ট্রাস নয়। নাম, ভিলহেলমস্ট্রাসে। এই রাস্তার নামকরণ ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরেও ভিলহেলমস্ট্রাসের আশপাশে কোন গলি ছিল না কখনোই। রাস্তার ম্যাপ আঁকা আছে (পুরোনো এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের।) ভিলহেলমস্ট্রাসের ডাইনে ও বামে বিশাল-বিশাল রাস্তা। আঠারো শতকের মধ্যপর্ব থেকেই এই অঞ্চল ছিল এলিট তথা বনেদিকুলের বিচরণভূমি। নানা সাজপোশাকে বৈকালিক ভ্রমণের, প্রেমের, হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর মুক্তাঞ্চল। জার্মানির অন্যকোন রাস্তা নয়, ভিলহেলমস্ট্রাসে যে দখল করবে, সেই জার্মানির কর্তা। বিসমার্কের আমল থেকে এখনও। ভিলহেলমস্ট্রাসে সংলগ্ন রাইখস্টাগ (সংসদ)। ভিলহেলমস্ট্রাসেতে ছিল হিমলার, গ্যোয়েরিংয়ের অফিস। এবং হিটলারের আস্তানা। বাঙ্কার (ওই বাঙ্কার পারিজার প্লাতস পর্যন্ত। দীর্ঘ এক কিলোমিটার।) ঘনাদার গলির হদিস পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য গল্প। গল্পের নাম ‘দাদা’। সব দেশেই এখন দাদা আছেন, বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে। চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে আছেন কি না, বলতে অপারগ। দেখিনি। আমেরিকায়, ব্রিটেনে প্রায় এক মিলিয়ন বাঙালী। ইটালিতেও কয়েক লক্ষ। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়ি দেখতে গিয়েছি, দুই তরুণ, ‘ভাইজান কই যান?’ এও বাহ্য। তেলআবিবে হাঁটছি, চার যুবক সঙ্গে, গল্প করতে করতে গন্তব্যে এগোচ্ছে, গলায় খাস কুমিল্লার ভাষা, বাংলায় প্রশ্ন করতেই মহা খুশি, ‘দাদা, নোতুন আইছেন? ‘যদি জিজ্ঞেস করেন বাড়ি কোথায়, উত্তর : ইন্ডিয়ায়। ... ইন্ডিয়ার কোথায়? কলকাতার কোথায়। ...কলকাতার কোথায়? আরে দাদা, এত জিগান ক্যান। তোমাদের পদবি কী? ...বসু, দত্ত, ঠাকুর, রায়। কায়স্থ, ব্রাহ্মণ একসঙ্গে ? ...হেইডা আবার কী। বসু, দত্ত, ঠাকুর, রায় কী করে হলে? ...হেইডা জিগায়েন না। ওয়েস্টবেঙ্গলের চীফ মিনিস্টার জ্যোতি বসু আমাগো দ্যাশের। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাগো দ্যাশের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি। ওয়েস্টবেঙ্গলের এ্যাক ফিল্ম ডিরাক্টরের নাম রায়। নামের লগে যদু, মধু, হিমাংশু, পামশু বসাইছি। পাসপোর্ট পেলে কী করে ? টাকা দিলে বাংলাদ্যাশে কোন্ দ্যাশের পাসপোর্ট চান। হব (সব ) পাইবেন। মোরা ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট করছিলাম। হিঁদুর নামে। হালার দালাল আমাগো ফারান্সে (ফ্রান্স) পাঠাইবো বইলা এহানে পাঠাইছে। এহানে হিঁদু হইয়া আছি। হিঁদুর কদর আছে। মোছলমানের নাই। তয়, এহানে বহুত মোছলমান আছে। হ্যারা উচ্চবাচ্য করে না। আমরাও করি না। হোটেলে, রেস্তরাঁয় কাম করি। সুযোগ পাইলে যামু গা। এহানে আরো অনেক বাংলাদেশি মোছলমান আছে। হগ্গলের হিন্দু নাম। একই কাহিনী আরো অনেক দেশে। কেউ হিন্দু, কেউ খ্রীস্টান নামে। ভাগ্যের পরিহাস কিংবা ভাগ্যের অন্বেষণে নাম, ধর্ম এমনকি দেশও ওলোটপালট। যেমন আর্মেনিয়ায়। রাজধানী ইয়ারভানে খোদ পাবনার ছাওয়াল বলেন, মাই নাম ডেভিড এডওয়ার্ড (লক্ষ করুন ইংরেজী) । ক্যাথলিক, না, প্রোটেস্টান্ট ? ...এইডা কী কন। খ্রিস্টধর্মের কোন শাখার। ...ধইরা লন দুইডাই। নাম এডওয়ার্ড কেন? ...পাবনায় এডওয়ার্ড কলেজ আছে। তাই নাম লইছি এডওয়ার্ড। এই এডওয়ার্ড একটি ভারতীয় রেস্তরাঁয় কাজ করে। রেস্তরাঁর মালিক বাংলাদেশের। ইয়ারভানে অন্তত গোটা কুড়ি ভারতীয় রেস্তরাঁ, অধিকাংশ মালিকই বাংলাদেশের।
×