ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পারফিউম বডি স্প্রে শ্যাম্পু সাবান ব্যবহারে সাবধান ॥ নকলের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পারফিউম বডি স্প্রে শ্যাম্পু সাবান ব্যবহারে সাবধান ॥ নকলের ছড়াছড়ি

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ভেজাল, নকল ও মেয়াদবিহীন প্রসাধনীতে বাজার সয়লাব। সৌন্দর্যপিপাসু ক্রেতা প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছেন এসব প্রসাধনী কিনে। ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। চর্মরোগ ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি সত্ত্বেও থেমে নেই অবৈধ ব্যবসা। সবাই চায় নিজেকে সুন্দর করে দেখাতে। সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন প্রসাধনী, যা মুখের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সাহায্য করে। বর্তমানে ব্যবহৃত প্রসাধনীর বেশিরভাগই ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ। শহরের বিভিন্ন দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব প্রসাধনী। আসল পণ্যের মোড়ক অবিকল নকল করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। দেখে বোঝার উপায় নেই কোন্টি আসল, কোন্টি নকল। বিভিন্ন প্রসাধনী দোকানে ভারতীয় নামী-দামী ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর মোড়ক নকল করে বিক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। কোন কোন প্রসাধনীর গায়ে বিএসটিআইয়ের সিল পর্যন্ত নেই। কোন কোন প্রসাধনীর গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ নেই। এসব পণ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে ভুগছেন ক্রেতা। শুধু রাজধানীর ফুটপাথই নয়, দেশী-বিদেশী নামী ব্র্যান্ডের পারফিউম, ডিওডোরেন্ট, বডি স্প্রে, শ্যাম্পু, সাবান, লোশন, তেল, সেভিং ক্রিম, নেলপলিশসহ বিভিন্ন ভেজাল পণ্য বড় বড় শপিংমলেও বিক্রি হচ্ছে। ঘামের দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে অনেকেই নিয়মিত বডি স্প্রে, ডিওডোরেন্ট কিংবা পাউডার ব্যবহার করে থাকেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বডি স্প্রে, পারফিউম, ডিওডোরেন্ট এসবই রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। এগুলো এতটাই বিষাক্ত যে, এটি নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কারও দেহে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রবেশ করলে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরার লছমানগঞ্জ, বুড়িশুর, মান্দাইল, কালিন্দিতে শতাধিক নকল কসমেটিকস কারখানা রয়েছে। অপরদিকে পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বড়কাটরা, সদরঘাট, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, রহমতগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, ইসলামবাগ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, শহীদনগর, টঙ্গীসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের পাগলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নকল প্রসাধন তৈরির গুদাম ও কারখানা রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, চকবাজারের বিভিন্ন কারখানায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই নকল ফেয়ার এ্যান্ড ল্যাভলী, ম্যাক্স্র ফেয়ারনেসসহ বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির ফেসওয়াশ ও ক্রিম তৈরি হয়। এর পর চকবাজারের ব্যবসায়ীরা তা কিনে পাঠিয়ে দেয় বড় শপিংমলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এসব কারখানায় বিদেশী সবধরনের নকল প্রসাধনী তৈরি করা হয়, যা ব্যবহারে ভোক্তার চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। এছাড়া, চকবাজারের একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, দুবাই ও থাইল্যান্ডের নামী-দামী ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর নকল মোড়ক চীন থেকে বানিয়ে আনে। চকবাজারে অধিক মুনাফায় তা বিক্রি করা হয়। এসব প্রসাধনী নকল মোড়কে ভেজাল পারফিউম সরবরাহকারীরা পৌঁছে দেয় বড় বড় মলে। প্যানটিন, ডাভ, হেড এ্যান্ড সোল্ডার, সানসিল্ক, ক্লিয়ার, হেভক, হেক্সি, এক্স, ডয়েট, ভিটÑ সবই নামী-দামী প্রসাধনী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্যের পাইকারি মার্কেট পুরান ঢাকার লালবাগের খান সুপার মার্কেট। সেখান থেকে এসব পণ্য সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে; যাচ্ছে ঢাকা শহরের অভিজাত শপিংমলে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পোশাক কারখানায় কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত তরল সাবানের সঙ্গে রং ও সুগদ্ধি মিশ্রণ করে তৈরি করা হয় নামী-দামী ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু। বডি স্প্রে তৈরি হয় নিম্নমানের স্পিরিটের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়ে। সিরিঞ্জ দিয়ে তা খালি কন্টেনারের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আর ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমে ব্যবহার করা হয় চরম ক্ষতিকারক পদার্থ মার্কারি (পারদ)। আসল ব্র্যান্ডের লোগো প্রেসে তৈরি করে সেঁটে দেয়া হয় কন্টেনারের গায়ে। অনেক সময় হিট মেশিন দিয়ে বোতলটিতে স্বচ্ছ পলিথিনের মোড়ক পরিয়ে দেয়া হয়। এতে আসল ও নকল প্রসাধনীর পার্থক্য বুঝতে পারে না সাধারণ মানুষ। আর বেশি লাভের আশায় এসব নকল পণ্য বিক্রিতে উৎসাহ দেখান খুচরা ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর এক বেসরকারী কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আনিকা আলম বলেন, কিছুদিন আগে শ্যামলীর একটি দোকান থেকে গার্নিয়ারের একটি ফেসওয়াশ কিনেছিলাম। আগে যেটা ব্যবহার করেছি সেটার গন্ধের সঙ্গে এটার গন্ধ মিলছিল না। ভেবেছিলাম হয়ত নতুন করে বের করেছে বলে গন্ধ বদলেছে। ফেসওয়াশটি ব্যবহার করার ২-৩ দিন পরে আমার মুখে এলার্জি, র‌্যাশ, চুলকানি দেখা দেয়। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার বলেছে, যে ফেসওয়াশ ব্যবহার করেছি তা আমার ত্বক গ্রহণ না করাতে এই অবস্থা হয়েছে। বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত আমিনা আহমেদ। তিনি সব সময় ওলে ক্রিম ব্যবহার করেন। নিজের এলাকা মিরপুরের একটি দোকান থেকে ক্রিমটি কেনেন। তিনি জানান, ক্রিমটি কিনে ৩, ৪ দিন ব্যবহার করার পর থেকেই বুঝতে পারলাম এটি নকল। কারণ, ব্যবহার করার পর আমার মুখে ব্রণ ও চুলকানি দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল প্রসাধনী তৈরিতে মাত্রাতিরিক্ত এ্যাসিড, পানি, মোম, সুগন্ধি ও পারফিউম ব্যবহার করা হয়। এসব ত্বকের ভেতর ঢুকে লোমকূপ বন্ধ করে দেয়। এসব ভেজাল প্রসাধনী তৈরিতে মার্কারির মতো ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহৃত হয়। মার্কারিসহ যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তার কারণে শরীরে কঠিন রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ক্যান্সার, কিডনির মতো জীবনঘাতী ব্যাধিতেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মস্তিষ্কে বিষক্রিয়া হয়ে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে। এছাড়া অতিমাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ ত্বকের ক্ষতি করে। চুলকানি, এলার্জি, ব্রণ, র‌্যাশসহ ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে স্কিন ক্যান্সারের মতো বড় ধরনের রোগও দেখা দিতে পারে। ল্যাকমি, গার্নিয়ার, ওলে, লোটাসসহ বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফেসওয়াশ, ক্রিম, সাবান, ফেসিয়াল, ভারতীয় ফেসিয়াল, ম্যাসাজ ক্রিমসহ বিভিন্ন ধরনের নামী-দামী ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর নকল বিক্রি হচ্ছে শহরের বিভিন্ন দোকানে হরহামেশা। যেন দেখার কেউ নেই। সম্প্রতি র‌্যাব-১০, সিপিসি-৩, লালবাগ ক্যাম্পের একটি অভিযানিক দল ৬ হাজার পিস ভেজাল প্রসাধনী জব্দ করে। র‌্যাব-১০-এর অপারেশন অফিসার খায়রুল আলম জানান, মেজর সোহেল হাসানের নেতৃত্বে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমের উপস্থিতিতে চকবাজার থানাধীন ২/১ দেবীদাস ঘাট লেন, মেসার্স শাহিন কসমেটিকস্ কারখানার ২য় তলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল কসমেটিকস্ জব্দ করা হয়েছে। এ সময় কারখানার মালিক শাহিন আহম্মেদকে (৩৫), বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন নকল কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন, মজুদ ও বাজারজাতকরণের অপরাধে ১,৫০,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জব্দকৃত কসমেটিস সামগ্রী পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেন বলে জানান তিনি।
×