ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাদিরা মজুমদার

কয়েকটি নোবেল মেডেলের অদৃষ্ট ছিল...

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কয়েকটি নোবেল মেডেলের অদৃষ্ট ছিল...

নোবেল পুরস্কার দেয়ার রেওয়াজ চালু হয় ১৯০১ সাল থেকে। পুরস্কারের অংশ হিসেবে পুরস্কৃতকে সুন্দর কারুকাজ করা ডিপ্লোমা, কিছু অর্থপ্রাপ্তির ডকুমেন্ট এবং পুরস্কৃতের খোদাইকৃত নামসহ কারুকার্যময় সোনার মেডেল- মরক্কো চামড়া দিয়ে চমৎকার পরিপাটি করে তৈরি কেসের মধ্যে রাখা, দেয়া হয়। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত মেডেলগুলো ছিল তেইশ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। ১৯৮০ সাল থেকে মেডেলগুলো তৈরি হচ্ছে আঠারো ক্যারেটের সবুজাভ স্বর্ণের আবরণ (প্লেটেড) দিয়ে। স্বর্ণের দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মেডেলের ওজন নির্ধারিত করা হয়, তবে গড় ওজন ১৭৫ গ্রাম, যথেষ্ট ভারিই। মেডেলের পুরুত্ব ৫.২ মিলিমিটার ও ২.৪ মিলিমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে এবং ব্যাসে ছেষট্টি মিলিমিটার। আমাদের কাহিনীর বিষয়বস্তু নোবেল স্বর্ণ মেডেল। এই নোবেল মেডেলের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়, হৈচৈ সৃষ্টি করা ঘটনা না ঘটলে, কেউ তার কোন খোঁজখবর করে না। যেমন- ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের তিন ছেলেমেয়ে বাপের বাইবেল ও নোবেল মেডেলের উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছেন! গুরুত্বের বিবেচনায়, এই জিনিস দুটোর আর্থিক মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার তো হবেই। ২০১৩ সালে শপথ গ্রহণে প্রেসিডেন্ট ওবামা কিংয়ের ব্যক্তিগত বাইবেলটি ব্যবহার করেছিলেন যা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, ক্রিস্টি’স-এর নিলামে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীববিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন তাঁর নোবেল মেডেলটি বিক্রি করে দিলেন। নোবেল মেডেলকে ঘিরে নানা মেজাজের আরও কিছু ঘটনা রয়েছে। যেমন যেহেতু ২০১৫ সালটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্তির সত্তরতমপূর্তি বছর, তাই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত, নোবেল মেডেল গলিয়ে ফেলার কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। মহাযুদ্ধ পরিচালনার খরচাপাতি বিরাট। অস্বীকার কেউ করতে পারে না। আসলে যুদ্ধমাত্রই খরচাসাপেক্ষ। নাৎসি জার্মানি তাই বিজিত দেশে ঢুকে প্রথমেই স্বর্ণের সঞ্চয় (রিজার্ভস) কব্জা করত। এভাবে কত পরিমাণ স্বর্ণ তারা দখল করেছিল, তার হিসাব যে করা হয়নি তা নয়, হয়েছে। তবে একটি নয়, একাধিক। কারণ হিসাব করতে, ব্যবহার হয়েছে পরিচিত সব ধরনের একক পদ্ধতি -মেট্রিক, ইমপেরিয়াল, ট্রয় সবই। আবার আর্থিক মূল্য নির্ধারণের সময় সেই সময়কার ঐতিহাসিক মুদ্রামান নাকি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়সাধিত মুদ্রামান ব্যবহার হয়েছে, সেটিও বোঝার উপায় নেই। ফলে, হিসাবের জগাখিচুড়ির মহাসাগরে আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করা হলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, জার্মানরা সারা ইউরোপের আনাচে-কানাচে থেকে টনকে টন স্বর্ণ দখল করে রাজধানী বার্লিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে স্বর্ণ গলিয়ে নাৎসি সিল লাগিয়ে স্বর্ণের পি- বা বার তৈরি হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে, যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই স্বর্ণ নিয়ে জার্মানির বাইরে চলে যাওয়ার ওপরে নাৎসিরা কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দুটো কারণ ছিল। এক-ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানিকে প্রথম মহাযুদ্ধের খরচাপাতি কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করতে হচ্ছিল, দুই. গোপনে গোপনে (অবৈধভাবে) তারা সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠন করছিল। ফলে স্বর্ণের চাহিদা ছিল বিপুল। অবস্থা আরও খারাপ হয় যখন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ধনী ইহুদী, বামপন্থী, একাডেমিক, ইনটেলেকচুয়ালসহ মোটামুটি ধনীরা জার্মানি ত্যাগের সময় সঙ্গে করে দুর্দিনের সাথী স্বর্ণও নিয়ে যেতে থাকে। কাজেই ‘চিমটে’ পরিমাণ ব্যক্তিগত স্বর্ণ জার্মানির বাইরে পাঠানোও ছিল অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং শাস্তির পরিমাণ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নোবেল বিজয়ী দুই জার্মান পদার্থবিদ, একজনের নাম মাক্সফন লাউ অন্যজন জেমস ফ্রাঙ্ক, দেশের বাইরে সোনা পাচারের অপরাধ করে বসেন। কিভাবে? দুই বিজ্ঞানীই তাঁদের নোবেল মেডেল হিটলারের নজর থেকে নিরাপদে রাখার জন্য ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে পাঠিয়ে দেন। ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান- নীলস বোর, মেডেল দুটো নিরাপদে রাখার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু মহাসমস্যা হলো যে, ১৯৪০ সালের ৯ এপ্রিল জার্মানরা ডেনমার্ক ও নরওয়ে আক্রমণ করে বসে। ডেনিশরা খামোখা যুদ্ধটুদ্ধের মধ্যে না গিয়ে ছয়ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে। ফলে, নাৎসিরা তাদের বেশ কিছুটা স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করে, অর্থাৎ, বলা চলে যে নাৎসি-অধিকৃত ডেনমার্ক মোটামুটিভাবে নিরাপদ স্থানে পর্যবসিত হয়। অবশ্য, নাৎসিরা অবশ্যকরণীয় প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বর্ণ, ইহুদী ও ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং রাইখের জন্য আকর্ষণীয় জিনিসের খোঁজে কোপেনহেগেনের প্রতিটি দরজায় ঢুঁ মারা শুরু করে। তার মানে, তারা ইনস্টিটিউটেও আসবেই আসবে। নীলস বোরের অবস্থা এবারে কী হতে পারে!!! নোবেল মেডেল দুটো তো ফন লাউ (১৯১৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান) ও ফ্রাঙ্কের (১৯২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান) নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা...। এই মেডেল দুটো যে বিশুদ্ধ ২৩ ক্যারেটের তৈরি ছিল (এবং ওজন প্রায় দুই শ’ গ্রাম) এবং তাই দেশের বাইরে পাঠিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে- শুধু তাই নয়, তদুপরি প্রতিটি মেডেলে প্রাপক হিসেবে যাদের নাম রয়েছে, একই মাপের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক অবস্থার জন্য যথেষ্ট...। জাতীয় সমাজতন্ত্র তথা নাৎসিবাদের ও ‘জার্মান পদার্থবিদ্যা’র সরববিরোধী হিসেবে ফন লাউ সুপরিচিত, আর ফ্রাঙ্ক, প্রথম মহাযুদ্ধে স্বদেশভূমির পক্ষে যুদ্ধ করলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাঁর ইহুদিত্ব মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। গেস্টাপোর হাতে মেডেল দুটো পড়লে কী যে হবে, বোঝা তো মোটেই কঠিন নয়। নীলস বোরের যে কী পরিমাণ টেনশন হচ্ছে....! কপালগুণে বোরের গবেষণাগারে সেইদিন গিয়র্গি ডি হেভেসি নামের এক হাঙ্গেরীয় রসায়নবিদ কাজ করছিলেন। পরিস্থিতি দেখেশুনে তিনি বোরকে প্রস্তাব করেন যে, ইনস্টিটিউটের কোথাও মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখলে কেমন হয়? প্রস্তাবটি বোরের মোটেই পছন্দ হয় না। কারণ যে কোন মুহূর্তে নাৎসিরা চলে আসতে পারে এবং ক্যাম্পাসের চত্বরে তাজা মাটির নোংরা তাদের নজর মোটেই এড়াবে না। সত্যিই বটে! ডি হেভেসি সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি প্রস্তাব করেন, গবেষণাগারে তিনভাগ হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিড ও একভাগ নাইট্রিক এ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি সংমিশ্রণ, যাকে একোয়া রেজিয়া বা রাজকীয় জল বলা হয়, রয়েছে। নানা রকমের গবেষণা কাজে রাজকীয় জল ব্যবহার হয়ে থাকে এবং হাতে গোনা যে গুটিকয় রাসায়নিক বস্তু, স্বর্ণকে গলাতে সক্ষম, রাজকীয় জল তারই একটি। হয়ত.... এই রাজকীয় জল ... মেডেলও ...গলাতে পারে...। শুনেটুনে, আইডিয়াটি বোরের পছন্দ হয়, ঘাড় কাত করে সায় দেন। তারপরে, এই দুই পুরুষ রাজকীয় জলে নোবেল মেডেল দুটো ডুবিয়ে দেন। এককভাবে হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিড বা নাইট্রিক এ্যাসিড, কোনটিই স্বর্ণকে গলাতে সক্ষম নয়, রাজকীয় জলের সংমিশ্রণ হতেই হবে। রাজকীয় জলে ডুবন্ত স্বর্ণের ওপর রাসায়নিক প্রক্রিয়া প্রথমে করে নাইট্রিক এ্যাসিড, তারপরে আসে হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিডের ভূমিকা। আপাতদৃষ্টে রাজকীয় জলে স্বর্ণ গলন-প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়তবা (কয়েক ঘণ্টা লেগে থাকে), তবে টেনশনগ্রস্ত বোর ও ডি হেভেসির মনে হতে লাগল যে, মেডেল দুটোর গলন-প্রক্রিয়া বুঝিবা অনন্তকাল ধরেই চলছে, চলবে...! কয়দিন নাকি কয়েক সপ্তাহ কি লাগবে...? যখন তখন নাৎসির আগমনে ত্রস্ত দুই নার্ভাস বিজ্ঞানী কয়েক ঘণ্টা ধরে পলকহীন রাজকীয় জলে গলমান মেডেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন তো থাকেনই... প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট... এত দীর্ঘ! নাৎসিরা ঠিকই আসে, নিচ থেকে ওপর, ওপর থেকে নিচ, সারা ইনস্টিটিউট তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করে। এমন পরিস্থিতিতে, নামীদামী নোবেল বিজয়ী নীলস বোর ‘মূল্যহীন’। তবে, রাজকীয় সম্ভ্রমের ঐতিহ্য বজায় রেখে রাজকীয় জল মেডেলের গলনকরণ আগেই সম্পন্ন করে রেখেছিল। শেলফে রাখা আর সব রসায়নের সঙ্গে দ্রবীভূত স্বর্ণের রাজকীয় জলের জারটিও ছিল, নাৎসিরা সেটি খেয়ালও করেনি বা এমন কিছু বিষয় মনেই আসেনি। এই ঘটনার কিছুদিন পরে, ডি হেভেসি স্টকহোমে পালিয়ে চলে যান, কিন্তু নীলস বোর ইনস্টিটিউটে থেকে যান। তবে ১৯৪৩ সালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে, ভাই হ্যারাল্ডসমেত, বোর সুইডেনে পালিয়ে যান এবং যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। যুদ্ধ শেষে, ১৯৪৫ সালে ডি হেভেসি, নীলস ও হ্যারাল্ড বোর ফিরে আসেন কোপেনহেগেনে। ইনস্টিটিউটে তাঁদের জন্য যে এমন সুন্দর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করবে, ভাবতেই পারেননি তাঁরা। ডি হেভেসি গবেষণাগারের যে শেলফে দ্রবীভূত স্বর্ণের রাজকীয় জলের জারটি রেখে গিয়েছিলেন, সেটি সেখানেই রয়েছে। আপাতদৃষ্টে কেউ কোনদিন স্পর্শও করেনি বলে মনে হলো তাঁর। তিনি এ্যাসিড থেকে স্বর্ণকে পৃথক করেন এবং সুইডেনের নোবেল প্রাইজ কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই আদি ছাঁচ ব্যবহার করে ডি হেভেসির পাঠানো স্বর্ণ দিয়ে নোবেল কমিটি দুটো আদি ‘অরিজিনাল’ মেডেল তৈরি করে।
×