ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা হত্যার ৬ বছর আজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা হত্যার ৬ বছর আজ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ আজ বিডিআর বিদ্রোহের নামে স্মরণকালের জঘন্যতম সেনা হত্যাযজ্ঞের ৬ বছর। এদিন বিডিআর বিদ্রোহীরা তথাকথিত দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে ৫৭ জন মেধাবী ও চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একসঙ্গে এত সেনা কর্মকর্তা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও নিহত হওয়ার নজির নেই। হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের ফৌজদারি আইনে বিচার চলছে। আর বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআর আইনে দোষীদের শাস্তি হয়েছে। বাংলাদেশে আর যাতে কোন বাহিনীতে এমন বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে এজন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। বিডিআরের নাম বিজিবি রাখা হয়েছে। নতুন আইনে শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়েছে। ইতিহাসের জঘন্যতম সেই বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সকালে সাড়ে ৯টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সভাপতিত্বে পিলখানা বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক দরবার শুরু হয়। এরই মধ্যে দরবার হলে উপস্থিত জওয়ানরা জাগো বলে হুংকার দিয়ে দরবার হল ত্যাগ করে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিমকেও টেনে হিঁচড়ে বের করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে অস্ত্রাগার লুট করে। বিদ্রোহী সিপাহি মাঈন লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করে। এ সময় উপস্থিত অন্যান্য চৌকস সেনা কর্মকর্তারা মাঈনকে নিরস্ত্র করে ফেলেন। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শত শত বিদ্রোহী অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলিতে পুরো দরবার হল ঝাঁঝরা হয়ে যায়। বিদ্রোহীদের সরাসরি মদদ দেয় সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক। বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর চালাতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। আর একে একে বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করতে থাকে। যা মহান স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর নির্মমতাকেও হার মানায়। পৈশাচিক সেই হত্যাকা-। বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা প্রাণ বাঁচাতে নিজের পোশাক খুলে বিডিআর জওয়ানের পোশাক পরেন। একজন সেনা কর্মকর্তা সন্তানের স্কুলের বেতন দেয়ার জন্য বিডিআরের স্কুলে যান। সেখানেই হামলা করে উন্মত্ত বিদ্রোহীরা। সেই সেনা কর্মকর্তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখেন। তিন দিন সেখানেই লুকিয়ে ছিলেন। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই সেনা কর্মকর্তা আর প্রধান শিক্ষিকার কপালে খাবার হিসেবে জুটেছিল দেড় লিটার পানি। দেড় লিটার পানিতেই কোনমতে জীবন বাঁচে সেই সেনা কর্মকর্তার। পরে যখন তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তিনি ক্ষুধার যন্ত্রণায় টেবিলের নিচ থেকে বের হতে পারছিলেন না। বড় পৈশাচিক সেই হত্যাকা-। অনেক সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দৌড়ে পালানোর নির্দেশ দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে উন্মাদ বিডিআর বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীরা দরবারে হলে উপস্থিতদের মধ্যে যাঁদের পেয়েছে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দরবার হল থেকে একজন সেনা কর্মকর্তাকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। নেয়ার সময় সেনা কর্মকর্তারা খুনী বিডিআর বিদ্রোহীরা আমবাগান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সেনা কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে জওয়ানদের এমন নির্দেশ শাস্তি হিসেবে ভেবে দৌড়ে পালাতে যান, ঠিক তখনই তাঁর পায়ে পর পর কয়েকটি গুলি করে বিদ্রোহীরা। এরপর আহত সেনা কর্মকর্তাকে টেনে-হিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই সেনা কর্মকর্তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে বিডিআর বিদ্রোহীরা। এভাবেই চলতে থাকে পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ। ২৫ ফেব্রুয়ারির রাতে কোয়ার্টারে সেনা কর্মকর্তাদের সার্চ করতে যায় বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের ধরে এনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। বিদ্রোহীরা বাসায় তছনছ করে। টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পুরো পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে বিদ্রোহীরা। বিডিআরের নিহত সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের স্ত্রীকে বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীরা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর বিদ্রোহীরা শুরু করে পৈশাচিক আচরণ। তারা মৃতদেহ ম্যানহোল দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অনেকের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। গণকবর দেয়া হয় অনেক সেনা কর্মকর্তাকে। হত্যাযজ্ঞের পর দ্রুত লাশ গুম করতে মৃতদেহগুলো খুবই আপত্তিকর অবস্থায় যত্রতত্রভাবে গণকবরে পুঁতে ফেলা হয়। মৃতদেহ ফেলে দেয়া হয় ড্রেনে, ম্যানহোলে, নর্দমায়। অনেক মৃতদেহ একসঙ্গে এলোপাতাড়িভাবে যাচ্ছেতাইভাবে গর্তে পুঁতে ফেলা হয়। বিডিআর বিদ্রোহের সময় ও পরে সারাদেশের ৭টি ইউনিট বা সাব ইউনিট ব্যতীত ৬০টি ইউনিটে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। সারাদেশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে বিদ্রোহের ঘটনায় মামলা হয়। মামলা পরিচালনার জন্য ৬টি বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ বহুল আলোচিত সেই দরবার হলেই বিডিআর বিদ্রোহের বিচার শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ৬টি আদালতের মাধ্যমে সারাদেশের বিডিআর বিদ্রোহের বিচার শুরু হয়। এতে বিচারকার্য সম্পাদন করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। এজন্য জাতীয় সংসদে বিডিআর বিদ্রোহের বিচার গতিশীল করার জন্য একাধিক আদালত স্থাপনের অনুমোদনের একটি সংশোধিত আইন সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। ১৯৭২ সালের বিডিআর বিদ্রোহের আইনে আসামিদের বিচার সম্পন্ন হয়। এটি ছিল স্মরণকালের অন্যতম স্বচ্ছ বিচার। বিচার কার্যক্রম সরাসরি মিডিয়ায় প্রচার ও মিডিয়ার সামনেই করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ মুখে অথবা নিজ খরচায় নিয়োগকৃত আইনজীবীর মাধ্যমে তার বক্তব্য আদালতে তুলে ধরতে পেরেছেন। যেসব বিদ্রোহী তা করেননি তাদের জন্য বিডিআরের তরফ থেকেই অভিযুক্তদের আইনী সহায়তা দিতে ফ্রেইন্ড অব দি এ্যাকিউজড হিসেবে বিডিআরের উর্ধতন একাধিক কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কোন অভিযুক্ত বিদ্রোহী নিজেকে দোষী দাবি করলে, আদালত তার শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা ও শিথিলতাও প্রদর্শন করছেন। আইন অনুযায়ী বিদ্রোহীরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে বিদ্রোহের ঘটনায় রাজধানীর তৎকালীন লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খীসা হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে লালবাগ থানায়ই পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। মামলা ২টি পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। ফৌজদারি আইনে মামলা ২টির তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ তথ্য বিভাগ (সিআইডি)। শুরু হয় মামলার তদন্ত। সিআইডি ঘটনাস্থল থেকে ৩৭শ’টি আলামত সংগ্রহ করে। ওইদিন পিলখানায় প্রায় ১১ হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিল। হত্যাযজ্ঞ মামলায় মোট ২২০৫ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার তদন্তে ৭৯৭৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। মামলায় ৫৪১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। আসামিদের মধ্যে ২০ জন পলাতক। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, বিডিআর হত্যাযজ্ঞে পিস্তল, এলএমজি, এসএমজি ও গ্রেনেডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩৭শ’টি অস্ত্র ও অস্ত্র অনুযায়ী গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্রোহের সময় পিলখানা থেকে ১শ’ ৯৯টি গ্রেনেড, ৬৪টি পিস্তল ও ৫টি রাইফেলসহ প্রায় ৩শ’টি অস্ত্র খোয়া গেছে। বিদ্রোহে সম্পদ ও অর্থের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার হিসাব সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে এ মামলার চার্জশীট দাখিল করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ। মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, যুবলীগ নেতা লেদার লিটন, ডিএডি তৌহিদুল আলম ও নাসিরসহ ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ৩ জন ইতোমধ্যেই মারা গেছেন। তাদের অভিযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ২০ জন পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুরনো ঢাকার বকশীবাজার আলীয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে ঢাকার জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস বসিয়ে হত্যাযজ্ঞ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়েরকৃত পৃথক মামলা ২টির বিচার কাজ চলছে।
×